দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও জনবহুল শহরগুলোর একটি হচ্ছে ঢাকা। জনসংখ্যার বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম এবং সমগ্র বিশ্বের মাঝে নবম বৃহত্তম শহর। জনবহুল এ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য স্থাপত্য। এসব স্থাপত্য ধীরে ধীরে অঞ্চলভেদে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
ঢাকার বিখ্যাত ও চোখ জুড়ানো স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ধানমন্ডি লেকের পাশ ঘেষে তৈরি ‘জাহাজ বাড়ি’ খ্যাত ‘চিশতিয়া প্যালেস’। যদিও বর্তমানে এটি বাস্তব জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে শুধু স্মৃতির পাতাতেই রয়ে গিয়েছে। আজকের আমাদের লেখা সেই বিখ্যাত বাড়িটি নিয়েই।
কয়েক বছর আগে ঢাকার সীমান্ত স্কয়ারের পাশ্ববর্তী ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে চলাচলের সময় অনেকটা খয়েরি রংয়ের জাহাজাকৃতির বিশাল এক ভবন চোখে পড়ত। এটি তখন অনেকের কাছেই বেশ রহস্যময় ছিল, কারণ আমাদের দেশে প্রচলিত স্থাপত্যের তুলনায় এর গঠন ও নকশা বেশ আলাদা। এমনকি এ বাড়িতে প্রবেশেরও তেমন অনুমতি ছিল না। তাছাড়া বাড়িটির বসবাসকারীদের অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকাও এ কৌতূহলের অন্যতম কারণ। ফলে স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীদের অনেকে বাড়িটিকে কখনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আবার কখনও আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিস মনে করত। কারও কারও কাছে এটি ভৌতিক বাড়ি বলেও পরিচিত ছিল।তবে গঠনশৈলির কারণে পথচারীদের কাছে এ বাড়িটি ‘জাহাজ বাড়ি’ নামেই খ্যাত ছিল। এ বাড়িটির আসল নাম হচ্ছে ‘চিশতিয়া প্যালেস (Chistiya Palace)’। তবে অনেকে ‘ক্রিস্টিয়া প্যালেস’ও উচ্চারণ করে।
ইতিহাস
চিশতিয়া প্যালেসের তৈরি সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৯৯৩ সালে প্রায় ১৬ কাঠা জমির উপর এ বাড়িটি তৈরির কাজ শুরু হয় এবং মাত্র এক বছরের মাথায় বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। চিশতিয়া প্যালেসের স্বত্বাধিকারীর নাম হচ্ছে ‘শের এ খাজা’। তবে তার আসল নাম হচ্ছে একেএম আনোয়ারুল হক চৌধুরী। তার জন্মস্থান ও জন্মতারিখ সম্বন্ধে সঠিক কোন তথ্য জানা যায়নি। যতটুকু জানা যায়, তিনি ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহন করেন। বাড়িটির ন্যায় বাড়ির মালিকও ছিল বেশ রহস্যময় একজন ব্যাক্তি। তাই তার সম্বন্ধে খুব কম ব্যক্তিই জানেন।
তবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে তার ওঠাবসা ছিল। যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী, ভারতের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেব গৌড়া, ভারতের উপরাষ্ট্রপতি কৃষ্ণ কান্ত, জাতিসংঘের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ইকবল রেজা প্রমুখ।
জানা যায়, এর মূল কারন ছিল তার সঠিক ভবিষ্যৎ বাণী করার ক্ষমতা। ফলে অনেক নেতাদের পদচারণাও ছিল এ জাহাজ বাড়িতে। আরও জানা যায়, তার ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে নাকি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যাক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং এজন্য তাকে “কিং অব কিং মেকার” বলা হত।তিনি সুফিবাদি মতাবাদ দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তবে প্রচলিত সুফিবাদী পুরুষের মত কানকায়ে শরীফ বা জলসার আয়োজন করতেন না। ছিল না কোন মুরিদও।
তিনি বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং একজন সফল ব্যাবসায়ী এবং মানবহিতৈষী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন গার্মেন্টস ব্যাবসায় জড়িত ছিলেন এবং “চিশতিয়া গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ” নামে তার একটি কোম্পানি রয়েছে। তাছাড়া ১৯৮১ সালে তিনি “ওয়ার্ল্ড পিস এন্ড ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (WPEDO)” নামক মানবহিতৈষী সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর মাত্র ৫৯ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যায়। পরবর্তীতে তার লাশ দেশে এনে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর পর তার একমাত্র ছেলে রুবেল চৌধুরী “চিশতিয়া গ্রুপ অব কোম্পনি” এর দায়িত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু শের এ খাজার মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত মানবহিতৈষী সংগঠন ওয়ার্ল্ড পিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (WPEDO)” এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
শেরে এ খাজার মৃত্যুর পর তার মা, স্ত্রী রেহানা চৌধুরী, পুত্র রুবেল চৌধুরী, কন্যা সাদিয়া চৌধুরী এ বাড়িতে বাস করতেন। তার ছেলে রুবেল চৌধুরীর স্ত্রী নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার নাতনী হন।
গঠন ও কাঠামোঃ
ধানমন্ডি ৫/এ রোডে অবস্থিত বাড়িটির গঠন ও নকশাই এর অাকর্ষনের মূল কারন। তবে বলে রাখা ভাল, ১৯৯৪ সালে বাড়িটির কাজ শেষ হবার সময় এর অাকৃতি জাহাজের মত ছিল না। নির্মানের কিছু সময় পর “ঢাকা সিটি কর্পোরেশন” বাড়িটির লেকসংলগ্ন প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙ্গে সেখানে চলাচলের রাস্তা তৈরি করে। তখন বাড়ির মালিক বাড়িটির সীমানার প্রাচীর জাহাজের অাদলে তৈরি করে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক তার বাড়ির প্রাচীরের অংশ ভেঙ্গে ফেলতে চাইলে উনি কিছুটা মনক্ষুন্নও হন। এ তথ্যটির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় “দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন” এর বর্তমান সম্পাদক নাইম নিজামের লেখায়। ১৫ জুন, ২০১৯ তারিখে নাইম নিজাম তার পত্রিকায় “শেরে খাজা, সাইদাবাদী ও চিশতির পাওয়ার হাউস কাহিনি” শিরোনামে একটি সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন যে, জাহাজ বাড়ির প্রাচীর ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত যখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় খাজা সাহেবকে জানায়, তখন খাজা সাহেব নাইম নিজাম সাহেবকে ফোন করে উনার বাসায় অাসার জন্য বলেন এবং অনেকটা অভিযোগের সুরে বলেন “পূর্তমন্ত্রণালয় লেকের পাশ দিয়ে সড়ক নেবে অামার সুন্দর বাড়িটা ভেঙ্গে। যার উত্তরে নাইম নিজাম সাহেব বলেন ” লেকের তীরে হাঁটা পথ হলে তো ভালো। আপনার বাড়ি দেখে দেখে মানুষ হাঁটবে। ছবি তুলবে। খারাপ কী!” একথা শুনে নাকি খাজা সাহেব মন খারাপ করেছিলেন। প্রায় ১৬ কাঠা জায়গা নিয়ে তৈরি এ বাড়িটির অায়তন ১৫ দশমিক ৮১ কাঠা। চিশতিয়া প্যালেসে প্রবেশের জন্য ছিল দুটি ফটক। প্রথম ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখা যেত বিশাল এক সুইমিংপুল। সেখান থেকে কিছুদূর সামনে এগুতেই দেখা পাওয়া যেত দ্বিতীয় ফটকটির। দ্বিতীয় ফটকটি দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা যেত একটি বারান্দা যার পাশেই ছিল মূল ভবনে উঠার সিড়ি। বাড়িটি তিন তালা ছিল। তবে, এ বাড়িটিতে ছিল মোট ৩৭টি গুম্বজ(মিনার)। প্রধান গুম্বজটি লম্বায় ১৬ তলা ভবনের সমান ।
ভেঙ্গে ফেলাঃ
২০১১ সালে জনাব শেরে খাজার মৃত্যুর পর তার মা, স্ত্রী রেহানা চৌধুরী, পুত্র রুবেল চৌধুরী ও কন্যা সাদিয়া চৌধুরী এ বাড়িতে থাকতেন এবং পরবর্তীতে জাহাজ বাড়িটির বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরায় তার পরিবার এটিকে সংস্কার না করে, বাণিজ্যিক ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা গুলশানের “শান্তা হোল্ডিং” কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি মোতাবেক ১৪ তলা ভবন নির্মানের জন্য ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাড়িটি ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়।
মোঃ জাকির নামে এক ঠিকাদারের সাথে ৫ মাসের মধ্যে বাড়িটি ভেঙ্গে ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জায়গাটি “শান্তা হোল্ডিং” কে বুঝিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু বাড়িটির গাঁথুনি খুব বেশি শক্ত হওয়ায় সম্পূর্ণ বাড়ি ভাঙ্গতে অারও ২ মাস সময় লাগে। ঠিকাদার মোঃ জাকির সাহেবের ভাষ্যমতে ” আর ১০টা বাড়ির চেয়ে এ বাড়ির গাঁধুনি খুব শক্ত। ভবনটি নির্মাণে প্রচুর সিমেন্ট ও রড ব্যবহার করা হয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও দেয়াল ভাঙতে পারছেন না শ্রমিকরা। দ্বিগুণ সময় দিয়ে ভবনটি ভাঙার কাজ করতে হচ্ছে।”
বর্তমান অবস্থাঃ
এ রহস্য ঘেরা জাহাজ বাড়ি এখন শুধুই স্মৃতি। সেখানে এখন “শান্তা হোল্ডিং” কোম্পানির নির্মিত বহু অাধুনিক সুবিধা নিয়ে তৈরি একটু বহুতল(১৪ তলা) ভবন দেখা যায়। ভবনটিতে জিম, সুইমিংপুল ও কমন স্পেস সহ অনেক ধরনের নাগরিক সুবিধা বিদ্যমান। এ বহুতল ভবনটির নাম দেয়া হয়েছে “চিশতিজ ইয়ট (CHISTY’S YACHT)”। বর্তমানের এ বহুতল ভবনটিতে রয়েছে ২০টি এপার্টমেন্ট যার প্রত্যেকটি প্রায় ৩০০০ স্ক্যায়ার ফিট। নতুন এ ভবনটির নকশা করেছেন বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী নাহাস অাহমেদ খলিল। “শান্তা হোল্ডিং” কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় তারা জুলাই,২০২০ এর মধ্যে তাদের কাজ শেষ করে তাদের গ্রাহক ও মালিকপক্ষকে এপার্টমেন্ট বুঝিয়ে দিবে।
রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর সবথেকে জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে একটি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় সাতচল্লিশ হাজার মানুষ বসবাস করা এ শহরটি তার বাসিন্দাদের অাবাসন সমস্যা মিটাতে একে একে বলি দিচ্ছে এর অপরূম সুন্দর স্থাপনাগুলোকে। হয়ত, এরকমই এক বলির উদাহরণ ধানমন্ডির “জাহাজ বাড়ি” খ্যাত “চিশতিয়া প্যালেস”। অস্তিত্ব থেকে বিদায় নিলেও হয়ত দীর্ঘদিন মানুষের মনে বেঁচে থাকবে এ অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত স্থাপনাটি।