এই সময় জ্বর মানেই আতঙ্ক। করোনা মহামারির সময় যেকোনো জ্বর ও সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলেই নিজেকে আলাদা করে রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মানা আর কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে এটা ডেঙ্গু জ্বরেরও মৌসুম। বাংলাদেশে মার্চ–এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাস পর্যন্ত থাকে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত বছর পর্যন্ত এই সময়ে জ্বর হলেই ডেঙ্গু সন্দেহে পরীক্ষা করার কথা বলা হতো। এখন যুক্ত হয়েছে আরেক রোগ—কোভিড–১৯।
বুঝবেন কীভাবে
কোভিড–১৯ বা ডেঙ্গু—দুটোই ভাইরাসজনিত জ্বর। দুটোতেই কিছু উপসর্গ একেবারে এক রকম। যেমন: জ্বর বা জ্বর–জ্বর ভাব, শরীর মেজমেজ করা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি। তবে এদের কিছু বিশেষত্বও আছে। ডেঙ্গু জ্বর হলে জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরের হাড়ে ব্যথা থাকে। আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে গলাব্যথা, অরুচি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয়।
লক্ষণীয় যে ডায়রিয়া বা পেটের সমস্যা দুটোতেই হতে পারে। দুটো ক্ষেত্রেই ক্ল্যাসিক্যাল উপসর্গ না–ও থাকতে পারে। তাই জ্বর ডেঙ্গু না করোনার কারণে, বোঝা মুশকিল হতে পারে অনেক সময়। তাই এ সময় জ্বর হলে দুটো পরীক্ষাই করে ফেলা ভালো। আর রোগের কিছু ইতিহাস, যেমন ঘনিষ্ঠ কারও করোনা হওয়া বা করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস থাকলে তা গুরুত্বপূর্ণ।
পরীক্ষার সমস্যা
জ্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই দুটোর পরীক্ষা করে ফেলতে পারবেন। ডেঙ্গুর জন্য নেওয়া হবে রক্ত—তাতে ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হয়। আর করোনার জন্য সাধারণত নেওয়া হয় নাক বা শ্বাসতন্ত্রের নিঃসরণ। করা হয় আরটি–পিসিআর টেস্ট। আর দুই ক্ষেত্রেই রক্তের সিবিসি, প্লাটিলেট কাউন্ট, যকৃৎ ও কিডনির পরীক্ষা করা হলে ভালো। কারণ, চিকিৎসার ক্ষেত্রে এগুলোর রিপোর্ট কাজে লাগতে পারে।
সিঙ্গাপুর ও ব্রাজিলের কিছু কেসস্টাডি দেখাচ্ছে যে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে একই সঙ্গে দুটি ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ হলে করোনা পজিটিভ হলেও ডেঙ্গু এনএসওয়ান নেগেটিভ আসতে পারে। ডেঙ্গু একধরনের আরবো ভাইরাস আর করোনা হলো সার্স ভাইরাসের গোত্রভুক্ত। তারপরও এই সমস্যা কেন হয়, তা বোঝা মুশকিল। তাই প্রয়োজনে একাধিকবার পরীক্ষা করা লাগতে পারে, যদি রোগীর উপসর্গ ও লক্ষণ সন্দেহের সৃস্টি করে। ডেঙ্গু আর করোনা একসঙ্গে হতে পারে কি? হ্যাঁ, হওয়াটা বিচিত্র নয়। তবে এ দুটি একত্রে হলে জটিলতার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে।
কী করণীয়
সত্যি বলতে কি ভাইরাসজনিত রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। ডেঙ্গু বা করোনা—দুইয়ের বেলায়ই এ কথা সত্য। যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, তা উপসর্গ ও জটিলতাভিত্তিক। তবে জ্বর হলে যেকোনো ব্যক্তিকে এখন বাড়িতে অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে হবে। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ সব নিয়ম মানতে হবে। দুই ক্ষেত্রেই পান করতে হবে প্রচুর পানি ও তরল। দরকার বিশ্রাম। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ খেতে পারবেন। পরীক্ষা করা ও রিপোর্ট পাওয়ার আগপর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে উপসর্গগুলো খেয়াল করুন। ডেঙ্গুর জটিলতা হিসেবে রক্তচাপ কমে যেতে পারে, মাড়ি, ত্বক বা অন্য কোনো অঙ্গ দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে। এ রকম হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে স্যালাইন নিতে হতে পারে।
আবার করোনার কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, রক্তে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রেও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন আর রক্ত জমাট বাঁধা বন্ধের ইনজেকশন নিতে হতে পারে। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডেঙ্গুতে রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ে আর করোনায় রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এ দুটি একে অন্যের বিপরীত। তাই খুব সতর্কভাবে চিকিৎসা করার দরকার হয়। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা, হিমাটোক্রিটের হিসাব, ডি ডাইমার, বুকের এক্স-রে ইত্যাদি রিপোর্ট তখন বিশেষভাবে কাজে আসবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি খাওয়া বিপজ্জনক। তাই নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। দুটো রোগই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সেরে যায়। তাই মনোবল ধরে রাখুন। আর সবচেয়ে বেশি নজর দিন প্রতিরোধে। হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব পালন করার পাশাপাশি বাড়িতে ও আশপাশে পানি জমে আছে কি না, মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, সেদিকে লক্ষ রাখুন।
ডেঙ্গু জ্বরে কখন ও কেন প্লাটিলেট প্রয়োজন
মানুষের রক্তে অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তকণিকা; যা কাজ করে রক্ত জমাট বাঁধতে। প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার স্বাভাবিক সংখ্যা প্রতি ঘন মিলিলিটারে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। কেবল ডেঙ্গু নয়, আরও নানা রোগে রক্ত সংক্রমণে এই প্লাটিলেটের সংখ্যা কমতে পারে। তবে তা কমে এক লাখের নিচে আসে সাধারণত জটিল সময়ে।

ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট সামান্য কমলেও সাধারণত এক লাখের বেশি থাকে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু জ্বর বা রক্তক্ষরণ হলেই সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলতে হলে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে রক্তের হিমাটক্রিট ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। সঙ্গে থাকতে পারে রক্তনালি থেকে রক্তরস বেরিয়ে আসা বা প্লাজমা লিকিংয়ের সমস্যা (যেমন প্রোটিন কমে যাওয়া, পেটে–বুকে পানি জমা) থাকবে। বিশ্বে প্রতিবছর ১০ থেকে ৪০ কোটি লোকের ডেঙ্গু হয়, এর মধ্যে খুব কমসংখ্যকের হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করার মাধ্যমে প্লাটিলেটের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। প্লাটিলেটের সংখ্যা এক লাখের কম হলে তাকে হেমোরেজিক বলে ধরে নেওয়া যায়।
আসলে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় প্লাটিলেট পরীক্ষার ভূমিকা শুধু হেমোরেজিক কি না, তা ডায়াগনসিসের জন্যই। ৮৯ থেকে ৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে বটে, তবে এদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশের জটিল পর্যায়ের নিচে যায়। মোটে ৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর মারাত্মক রক্তক্ষরণ জটিলতা হয় আর রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হতে পারে। প্লাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নামলে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। প্লাটিলেট যদি ৫ হাজারের কম হয়, তখন মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃৎপিণ্ডের মধ্য রক্তক্ষরণের ভয় থাকে।
তবে ডেঙ্গু জ্বরে যে রক্তক্ষরণের কারণ কেবল প্লাটিলেট কমা তা নয়, এর সঙ্গে অন্তত আরও ১১টি কারণ আছে। তাই শুধু এককভাবে প্লাটিলেট দিয়ে লাভ হবে না।
রক্তের প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে হলে অনেকে প্লাটিলেট সংগ্রহের জন্য ছোটাছুটি করেন। তবে বিভিন্ন গবেষণা দেখাচ্ছে, ২০ হাজারে যাঁরা প্লাটিলেট সঞ্চালন করেছেন, আর যাঁরা করেননি, তাঁদের মধ্যে শেষ অবধি রক্তক্ষরণের মাত্রা বা ধরনের কোনো তারতম্য হয়নি। রোগের পরিণতিতেও আলাদা কিছু প্রত্যক্ষ করা যায়নি। অনেক সময় দেখা যায়, প্লাটিলেট ১০ হাজার বা তারও নিচে নেমে যাচ্ছে, তবু কোনো রক্তক্ষরণ নেই, এর কারণ যে সংখ্যাতেই আছে, তা কার্যকরী প্লাটিলেট। তা ছাড়া ডেঙ্গুর জটিল পর্যায় পার হতে হতে প্লাটিলেট দ্রুত আবার বাড়তে থাকে।
এ জন্য অনেক দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, প্লাটিলেট ১০ হাজার পর্যন্ত নামলেও প্লাটিলেট সঞ্চালনের দরকার নেই। তবে এর নিচে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে প্লাটিলেট বিপজ্জনক মাত্রায় না নামা পর্যন্ত (২০ হাজারের নিচে) প্লাটিলেট বা রক্ত সংগ্রহ করার জন্য অকারণ দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ, খুব নগণ্যসংখ্যক রোগীরই শেষ পর্যন্ত তা দরকার হবে।
ডেঙ্গু রোগের আসল চিকিৎসা প্লাটিলেট সঞ্চালন নয়, বরং নিখুঁতভাবে পানিশূন্যতা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, প্লাজমা লিকেজ বা প্লাজমা রক্তনালির বাইরে যাতে চলে না আসে, সে চেষ্টা করা। রক্তক্ষরণের জন্য ডেঙ্গু রোগী মারা যায় না, বেশির ভাগের মৃত্যু ঘটে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। মানে রোগী যখন শকে চলে যায়, হৃৎস্পন্দন দুর্বল হয়ে পড়ে, রক্তচাপ নেমে যায় আর শরীরের বিভিন্ন অপরিহার্য অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। তা ছাড়া প্লাটিলেট এক বা দুই ইউনিট দিয়ে যেটুকু বাড়ে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।
মূলত ডেঙ্গুতে গুরুতর রক্তক্ষরণ হলে, যেমন মলের সঙ্গে রক্তপাত বা রক্তবমি হলে রক্তের বদলে রক্ত দেওয়াই উত্তম, প্লাটিলেট নয়। তা ছাড়া প্লাটিলেট সঞ্চালন খুবই ব্যয়সাধ্য ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এক ইউনিটের জন্য চারজন দাতাকে রক্ত দিতে হয়। সর্বত্র প্লাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই।
সব মিলিয়ে ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমা ও প্লাটিলেট জোগাড় নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা ও ছোটাছুটি করবেন না। সাধারণ ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, যথেষ্ট তরল খাবার খান। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে স্যালাইন নিন। ডেঙ্গু জ্বরের এর বাইরে আর তেমন কোনো চিকিৎসা নেই, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনা–আপনি সেরে যায়।