সীতাকুণ্ডে টিলার বুক চিরে তৈরি ৪০০ ঘর

সড়কের দুই পাশে ক্ষতবিক্ষত পাহাড়ের টিলা। এর বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট টিনের ঘর। এর কোনোটি আধাপাকা। কিছু ঘরে লাগানো হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামফলক। ঘরগুলো নির্মাণের সময় পাহাড়ের কোথাও আংশিক, কোথাও পুরোটাই কেটে সমতল করা হয়েছে। সাকল্যে ঘর বানানো হয়েছে ৪০০টির মতো।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট–বায়েজিদ সড়কের দুই পাশে দেখা গেছে এমন চিত্র।

সড়কটির দুই পাশে সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর মৌজা, হাটহাজারী উপজেলার জালালাবাদ মৌজা ও চট্টগ্রাম নগরের উত্তর পাহাড়তলী মৌজার সরকারি খাসটিলা শ্রেণির জায়গা। সবচেয়ে বেশি ঘর উঠেছে ৩৬১ দাগে ৪৬ কানি ও ৩৫৯ দাগে ১২৫ কানি জমিতে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে সড়কের দুই পাশে অন্তত ১৫টি পাহাড় কেটে ঘরগুলো বানানো হয়েছে। জঙ্গল সলিমপুর ও ফৌজদারহাটে পুলিশ ফাঁড়ি থাকা সত্ত্বেও পাহাড় কাটা ঠেকানো যায়নি। বরং ঘর নির্মাণে স্থানীয় একাধিক চক্র ছাড়াও অন্তত সাত পুলিশের নাম উঠে এসেছে।

প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর দুই দফা অভিযান চালালেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। উচ্ছেদ করা হয়নি ঘরগুলোও। ফলে প্রতি রাতেই তোলা হচ্ছে নতুন নতুন ঘর।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ছিন্নমূল মানুষের কাছে ভাড়া ও বিক্রি করার জন্য কয়েকটি চক্র এসব ঘর বানাচ্ছে।

তবে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, নির্মিত ঘরগুলো দ্রুততম সময়ে উচ্ছেদ করা হবে। ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়টি তাঁদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি।

স্থানীয়দের ভাষ্য

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘরগুলো নির্মাণে জমির আলী, মনির হোসেন, নাছির উদ্দিন ওরফে সিঙ্গাপুর নাছির, ‘ছিন্নমূল সমাজের’ একজন নারীনেত্রী ও সাতজন পুলিশ জড়িত রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি জায়গায় ঘর তুলেছেন নাছির ও মনিরের সিন্ডিকেট।

জমির, মনির ও নাছির স্থানীয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পুলিশ সদস্য যাঁদের নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন এসআই সাইফুল ইসলাম, এসআই দিপঙ্কর রায়, এসআই মিঠুন, নাজমুল, রহমান, হারুন, রুবেল। তাঁরা চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানায় কর্মরত।

এঁদের মধ্যে জমির আলী মোরশেদা বেগম নামে এক নারীর কাছ থেকে আমমোক্তারনামা নিয়ে বিভিন্নজনের কাছে জমি বিক্রি করছেন। যাঁরা কিনছেন, তাঁরা পাহাড় কেটে ঘর তুলছেন।

রাবেয়া আক্তার, মনিকা রানীসহ কয়েকজন বলেন, তাঁদের এলাকায় আটটি ঘর তোলেন মনির। তাঁদের ঘরগুলোর তদারকির দায়িত্ব দেন। কিন্তু এক দখলদারের তত্ত্বাবধায়ক নাছির তাঁদের সীমানা পিলার তুলে নিয়ে গেছেন।

জালালাবাদ মৌজায় সড়কের পাশে থাকা একটি টিনশেড ঘরের বাসিন্দা খালেদা আক্তার বলেন, তিনি যে ঘরে থাকেন, তার মালিক সীতাকুণ্ড থানার এসআই সাইফুল ইসলাম। পাশের ঘরগুলো আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের।

মনির হোসেনের মুঠোফোন বন্ধ ও নাছির উদ্দিন ফোন না ধরায় তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সীতাকুণ্ড থানার এসআই সাইফুল ইসলাম ও খুলশী থানার এসআই দিপঙ্কর রায় তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

স্পেক্ট্রার বিরুদ্ধে অভিযোগ

পাহাড় কাটার দায়ে গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এ ঘটনার পর গাড়িসহ সরঞ্জাম রাখার স্থানে দেয়াল দিয়ে সিডিএর ঠিকাদার স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স নতুন করে পাহাড় কেটে একটি লেকের কিছু অংশ ভরাট করেছে।

জানতে চাইলে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রবিউল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নতুন করে কোনো পাহাড় কাটেননি। যে অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেটির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর তাঁদের জরিমানা করেছে। এখন তাঁরা যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিয়েছেন। তবে সীতাকুণ্ডের ইউএনও মিল্টন রায় বলেছেন, তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করে লেক ভরাটের প্রমাণ পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *