ইউনেস্কোর ১০টি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান (10 UNESCO World Heritage Sites)

১.তাজ মহল , ভারত ( Taj Mahal, India):

ভারতের উত্তর প্রদেশে আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মুমতাজ মহল নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে যা সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে।

তাজমহলকে (কখনও শুধু তাজ নামে ডাকা হয়) মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতি রাজকীয় সমাধীটিই বেশি সমাদৃত, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। তখন একে বলা হয়েছিল ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠকর্ম।


. আঙ্করভাট, কম্বোডিয়ার(Angkor Wat, Cambodia):

আঙ্করভাট

আঙ্করভাট (অর্থাৎ “শহরের মন্দির”, “আংকর” হল সংস্কৃত “নগর” শব্দের স্থানীয় উচ্চারণ) কম্বোডিয়ার আংকরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় মন্দির। সুবিশাল এই স্থাপনাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির।

১২শ শতাব্দীতে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা ২য় সূর্যবর্মণ। তিনি এটিকে তার রাজধানী ও প্রধান উপাসনালয় হিসাবে তৈরি করেন। তখন থেকেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসাবে বিবেচিত। প্রথমদিকে হিন্দু মন্দির হিসাবে ব্যবহৃত হলেও পরে এটি বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়।

আঙ্করভাটের নির্মাণশৈলী খ্‌মের সাম্রাজ্যের স্থাপত্য শিল্পকলার অণুপম নিদর্শন। এটি কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায় স্থান পেয়েছে, এবং দেশটির প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।

আঙ্করভাটে খ্‌মের মন্দির নির্মাণ কৌশলের দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে – টেম্পল মাউন্টেন বা পাহাড়ি মন্দির ধাঁচ, ও গ্যালারি মন্দির ধাঁচ। এটি হিন্দু পুরাণের দেব-দেবীদের বাসস্থান মেরু পর্বতের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এর চারদিকে রয়েছে পরিখা ও ৩.৬ কিমি দীর্ঘ প্রাচীর। ভিতরে ৩টি আয়তাকার গ্যালারি বা বেদি আকৃতির উঁচু এলাকা রয়েছে। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে স্তম্ভাকৃতির স্থাপনা। আংকরের অন্যান্য মন্দিরের সাথে পার্থক্য হল – এটির সম্মুখ ভাগ পশ্চিমমুখী। মন্দিরটির বিশালত্ব, সৌন্দর্য ছাড়াও এর দেয়ালের কারুকার্যের জন্য এটি সারা বিশ্বে পরিচিত।


৩. মাচু পিচু, পেরু(Machu Picchu, Peru):

মাচু পিচু

মাচু পিকচু (কেচুয়া: Machu Pikchu মাচু পিক্‌চু অর্থাৎ “পুরানো চূড়া”) বা মাচু পিচু (স্পেনীয়: Machu Picchu মাচু পিচু) কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগের সময়কার একটি ইনকা শহর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ২৪০০ মিটার (৭,৮৭৫ ফিট)। এটি পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার (Valle de Urubamba) ওপরে একটি পর্বতচূড়ায় অবস্থিত। মাচু পিচুই সম্ভবতঃ ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শণ, যাকে প্রায়শঃ ইনকাদের হারানো শহর বলা হয়। এটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু এর এক শ বছর পর ইনকা সভ্যতা যখন স্পেন দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এটি পরিত্যাক্ত  হয়ে পড়ে। কয়েক শ বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে হাইরাম বিঙাম (ইংরেজি: Hiram Bingham) নামে এক মার্কিন ঐতিহাসিক এটিকে আবার সমগ্র বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে মাচু পিচু পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণী দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এটিকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে এটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বর্তমান বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়েরও একটি।


৪.  গিজার পিরামিডস, মিশর(Pyramid of Giza, Egypt):

গিজা'র পিরামিড

মিশোরের সবচেয়ে বড়, পুরোনো এবং আকর্ষনীয় পিরামিড হচ্ছে গিজা’র পিরামিড যা খুফু’র পিরামিড হিসেবেও পরিচিত। এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক ১ লাখ। পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে। পাথর খন্ডের এক একটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মত। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর দুরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সাথে পাথর জোড়া দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হত। চার হাজারের বছরের পুরানো এক সমাধিতে অঙ্কিত এক চিত্রে দেখা যায় এক বিশাল স্তম্ভকে স্লেজে করে সরানো হচ্ছে; অনেক মানুষ রশি দিয়ে সেই স্লেজ টেনে নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে একজন পাত্র থেকে জল ঢালছে বালির উপরে। এতে ঘর্ষণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আড়াই টন ওজনের এক একটা ব্লক।


৫. সুইস আল্পস জংফরাউঅ্যালেচ (Swiss Alps Jungfrau-Aletsch ):

দক্ষিণ-পশ্চিম সুইজারল্যান্ডের পূর্ব বার্নিজ আল্পসে হিমবাহের ৩৫,০০০ হেক্টর (১৩৫ বর্গমাইল) সহ এটি ইউরোপের বৃহত্তম হিমবাহ অঞ্চল। এটি আলেপস হিমবাহের বাড়ি, আল্পসের বৃহত্তম এই অঞ্চলটি জাইংফ্রেউ এবং আইজারের উত্তর প্রাচীরের মতো চূড়াগুলি দ্বারা প্রভাবিত। বার্নিজ আল্পসের সর্বোচ্চ পর্বতটি ফিনস্টেরাহোর্ন, ৪,২৭৪ মিটার (১৪,০২২ফুট)

 

 

 

 

 

 


. পেট্রা, জর্দান(Petra, Jordan):

পেট্রা, জর্দান

বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম ওয়াদি মুসা-র ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী। পেত্রা নগরী মূলত একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। এটি বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য। এটি তৈরি হয়েছে গুহার মধ্যে যা কোথাও কোথাও মাত্র ১২ ফুট চওড়া, মাথার ওপরে পাথরের দেয়াল। গুহার পাশেই রয়েছে কঠিন পাথরের দেয়ালের গায়ে গ্রথিত সেই প্রাচীন দালানগুলো যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দিরটি। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভান্ডার নামেও পরিচিত। আরো রয়েছে একটি অর্ধগোলাকৃতির একটি নাট্যশালা যেখানে প্রায় ৩০০০ দর্শক একসাথে বসতে পারে।

 


. চীনের মহাপ্রাচীর (Great Wall of China):

চীনের মহাপ্রাচীর

পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি দীর্ঘ প্রাচীর সারি। এগুলি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে খ্রিস্টীয় ১৬শ শতক পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য তৈরি ও রক্ষাণাবেক্ষণ করা হয়। এরকম অনেকগুলি প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, তবে ২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াঙের অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি বর্তমান প্রাচীরের অনেক উত্তরে অবস্থিত এবং এর খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। বর্তমান প্রাচীরটি মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়।

চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। এই প্রাচীর প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উচু এবং ৬২৬০ কিলোমিটার লম্বা। এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে।


৮. ঐতহিাসক কেন্দ্র রোম, (Historic Centre of Rome, Italy):

ঐতহিাসক কেন্দ্র রোম একটি মুক্তাঙ্গন জাদুঘর যা বিশ্বের কয়েকটি সুন্দর দর্শনীয় স্থান এর ঘর। এদের মধ্যে প্রধানত কলোসিয়াম, প্যানথিয়ন, এবং রোমান ফোরাম।

পুরাণ অনুসারে, রোম রোমুলাস এবং রেমাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭৫০ বিসি। রোম পরে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ৫ম শতাব্দীতে এডি এর পতনের আগ পর্যন্ত।

 


 

৯.চিচেন ইতজা (Chichen Itza):

চিচেন ইতজা

মেক্সিকানের ইউকাটান উপদ্বীপের একটি মায়ান শহর। চিচেন ইতজা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় পর্যটকণ স্থান, এবং একটি সক্রিয় প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হিসাবে সারা বিশ্বের নিকট অতি পরিচিত। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের আগমনের পূর্বে মায়ান জনগণের সংস্কৃতি এবং কৃতিত্ব সম্পর্কে আরও অন্তর্দৃষ্টি জোগানো এই অঞ্চলটিতে এখনও প্রায়শই নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। চিচেন ইতজা (chichen itza) ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের পরিচিতি পেয়েছিল এবং ২০০৭ সালে এটি নতুন সেভেন ওয়ান্ডার্স এর একটি হিসাবে যায়গা করে নেয়।


১০. ফ্লোরেন্স শহর (City of Florence):

ফ্লোরেন্স (ইতালীয়: মধ্য ইতালির তুস্কানি (তুস্কানা) অঞ্চল ও ফ্লোরেন্স প্রদেশের প্রধান শহর হিসেবে খ্যাত। রোমের উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে এ শহরের অবস্থান। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত মেয়াদকালে এ শহরটি আধুনিক ইতালি রাজতন্ত্রের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। আর্নো নদীর তীরে অবস্থিত ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে জনবহুল, যার সংখ্যা প্রায় ৩,৭০,০০০জন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ ও শহরের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনেস্কো ১৯৮২ সালে এ শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। সুপ্রাচীন ভবনগুলোয় চিত্রিত শিল্পশৈলীর মাধ্যমে ফ্লোরেন্সের জনগণের ধর্মীয়, শিল্পকলা, শক্তিমত্তা, এমন-কি অর্থ-প্রাচুর্য্যের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এ শহরের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, দাঁন্তে, ম্যাকিয়াভেলী, গ্যালিলিওসহ সুপরিচিত মেডিসি পরিবারের শাসকদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *