দুই পাঠ্যবই প্রত্যাহারের বার্তা সবার জন্য অশনিসংকেত

গোটা সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি—সবকিছু এখন মৌলবাদীকরণ হচ্ছে। এ নিয়ে রাষ্ট্রের উদ্বেগ তো দূরে থাক, উল্টো পৃষ্ঠপোষকতা করছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে সমঝোতার ভিত্তিতে। এই বই প্রত্যাহারের মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে, যা সবার জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনবে। মূলত মৌলবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার কারণেই আজ এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। ‘বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমবিষয়ক অপপ্রচার বন্ধ হোক’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি নামে একটি সংগঠন।

১০ ফেব্রুয়ারি আকস্মিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয় ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটির পাঠদান প্রত্যাহারের কথা জানায় এনসিটিবি। তবে কী কারণে বই দুটি প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচনের বছরে মূলত ‘রাজনৈতিক কারণেই’ সরকার বই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়।

বই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। বই দুটিতে ‘বিতর্কিত’ বিষয় যুক্ত করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিও করেছে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠনটি।

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, পাঠ্যবইয়ের সমস্যাগুলো নিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

 

 

তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে।

আজ গোলটেবিল বৈঠকে বই দুটি প্রত্যাহারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান বলেন, বই দুটিতে ভুলত্রুটি আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। তবে বানান ভুল থাকতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাঁরা সবার কাছে বিতর্কহীন থাকার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রও চায় সবার কাছে একটি সহনশীল পর্যায় থাকুক। এমন অবস্থায় তাঁরা বিবেচনা করেছেন, ওই দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করা হলেও শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে না।

মশিউজ্জামান আরও বলেন, ২০১৭ সালেও অপপ্রচার হয়েছে। কিন্তু এবারের অপপ্রচার মাত্রাহীন এবং মিথ্যা প্রচারণায় ভরপুর ছিল। এ সময় আক্ষেপ করে তিনি আয়োজকদের উদ্দেশে বলেন, ‘তখন একটু অসহায় বোধ করেছি, আপনারা কেউ আমাদের পাশে ছিলেন না।’

অসাম্প্রদায়িক দেশকে পুরোপুরি উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘আমাদের জীবদ্দশায় এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, ভাবি না। কী করে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশকে আমরা পুরোপুরি উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারি না।’

আক্ষেপ করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০১০ সালে একটি ভালো শিক্ষানীতি করা হয়েছিল, সেটাও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা যায়নি। মৌলবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার কারণেই আজ এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

সরকার আপসকামিতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করেন লেখক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি বলেন, পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে। কিছু নতুন বই হয়েছে। তা নিয়ে সমাজে বড় অভিঘাতের চেষ্টা হয়েছে। দুই বই প্রত্যাহারের মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে, এই বার্তা সবার জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির এনসিটিবির সদস্যের দেওয়া ‘পাশে না থাকার’ বক্তব্যে দ্বিমত করেন। এ সময় সরকারের অবস্থানকে ‘সাপ হয়ে দংশে, ওঝা হয়ে ঝাড়ো’-এর মতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, সরকার দুটি বই প্রত্যাহার করেছে। কাগজে দেখা গেছে হেফাজতে ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

গোলটেবিল বৈঠকে আয়োজক সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ওয়াইডব্লিউসিএর জাতীয় সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনীষা সরকার। তিনি বলেন, অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো আলোচনা ছাড়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ বিঘ্নিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর প্রমুখ ব্যক্তিরা করেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *