মানুষ জন্ম থেকেই নিজের ভেতরে একটা শূন্যতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এই শূন্যতা জাগতিক কিছুর জন্য নয়, বরং মানুষের ভেতরের পবিত্র সত্তার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সংযোগের এক তাড়না থেকে এর জন্ম হয়। পৃথিবীতে একজন ঘুমন্ত মানুষেরও যেমন অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই এই দেহে রুহ প্রবেশের পর থেকে প্রয়োজন হয় স্রষ্টার ভালোবাসা। সেই প্রয়োজনটা কি আমরা কখনো অনুভব করতে পারি? আমাদের দুনিয়ার জীবনে প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত সেই বিষয়ে বিবরণী তুলে ধরা হলো।
জীবন এমন এক সফর, যার শুরু মায়ের গর্ভে, সাময়িকভাবে শেষ হয় মাটির বুকে। এরপর শুরু হয় পরকালের চিরস্থায়ী জীবন। দুনিয়ার এই অস্থায়ী যাত্রা কেবলই একটি পরীক্ষা। আমাদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, সবই আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য থাকে ভালো রেজাল্টের কিছু সার্টিফিকেট, উন্নত ক্যারিয়ার, বিলাসবহুল জীবনযাপন, এ বিষয়গুলোর পেছনেই যে পৌনঃপুনিক ছুটে চলা। ছুটে চলার কারণ পার্থিব সুখ। এই পার্থিব সুখই যেন জীবনের গন্তব্য। আসলেই কি তাই? এগুলো পূরণ হয়ে গেলেই কি একজন মানুষ সুখী হতে পারে? হয়তো জীবনের নানা অর্জন তুলে ধরে বলবে ‘আমার সবকিছুই আছে, আমি তো ভালোই আছি।’
কিন্তু সত্যিই কি সেই মানুষগুলো ভালো থাকে? স্রষ্টার আনুগত্য ছাড়া কেউই প্রকৃত সুখী হতে পারে না। মহান আল্লাহ সেটা পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন।’ (সুরা তাহা ১২৪)
যে জীবনে মহান আল্লাহর আনুগত্য থাকে না, সেই জীবন যতই স্বাভাবিকভাবে চলুক না কেন, জীবনে সুখী হতে পারবে না। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর কেয়ামতের দিন তোমাদের পুরোপুরি প্রতিদান দেওয়া হবে। (সুরা আলে ইমরান ১৮৫)
এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের আসল গন্তব্যের কথা। সার্টিফিকেট, উন্নত ক্যারিয়ার, গাড়ি, বাড়ি, বিলাসবহুল জীবনযাপন, এগুলো জীবনের অন্যতম অংশ। এই অংশগুলো হলো জীবনের প্রকৃত গন্তব্যে সফল হওয়ার উপকরণ মাত্র। অথচ আমরা উপকরণ অর্জনকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে রেখেছি।
পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, সংসার বা দায়িত্বকে জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়ে হয়তো আমাদের প্রচেষ্টার সব পূরণ হবে। এই উদ্দেশ্য হয়তো পৃথিবীতেই পূরণ হয়ে যাবে। তখন বেঁচে থাকার জন্য আর কী উদ্দেশ্য খুঁজব? তখন হয়তো বেঁচে থাকার আর কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষের জীবনে এমন উদ্দেশ্য থাকা উচিত, যা এ জীবনে অর্জন সম্ভব নয়, শুধু পাথেয় কুড়িয়ে যাবে আর প্রত্যাশা রাখবে এবং এ উদ্দেশে পৌঁছানোর জন্য জীবনের প্রত্যেক অংশকে সমান গুরুত্ব দেবে।
পৃথিবীতে মানুষের অসুখী হওয়ার অন্যতম কারণ হলো নিজের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেও হয়তো এ বিষয়ে উদাসীনতা। বাইরে থেকে দেখতে মুসলিম হলেও আমাদের মধ্যে যেন কত বৈচিত্র্য! আমাদের স্রষ্টা এক, আমাদের বিশ্বাস এক, আমাদের রাসুল এক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য যেন ভিন্ন! আমরা ভুলে যাই আমাদের প্রকৃত গন্তব্যের কথা।
জীবনের প্রকৃত এই গন্তব্য মানুষ যদি মস্তিষ্ক-মননে ধারণ করতে পারত তাহলে আর সমাজে নিত্যদিনের ঘটনার মধ্যে ধর্ষণ, জুলুম, খুনের মতো এত বড় বড় অপরাধগুলো খবরের শিরোনাম হতো না।
তবে কি দুনিয়া উপেক্ষা করব? না, ইসলাম দুনিয়াকে অস্বীকার করে না। বরং এটাকে ব্যবহার করতে বলে আখেরাত অর্জনের জন্য। সার্টিফিকেট, উন্নত ক্যারিয়ার, হালালভাবে উপার্জন, পরিবার-পরিজনের দায়িত্ব পালন সবই ইবাদতের অংশ হতে পারে, যদি নিয়ত হয় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। এর পাশাপাশি স্মরণ রাখতে হবে চিরস্থায়ী জীবনের কথা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার জন্য বেশি চিন্তা করতে বলেননি। তিনি বলতেন, ‘তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো যেন তুমি এক পথিক অথবা এমন এক ভ্রমণকারী যে পথের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছে।’ (সহিহ বুখারি)
জীবন হলো পথ, আমরা হলাম পথিক। পথিকের তো স্থায়ী ঘর হয় না, তার চোখ থাকে গন্তব্যে। আমরাও যেন এমন পথিক হই, যাদের চোখ জান্নাতের দিকে। একজন পথিক যেমন জানে তার গন্তব্য রয়েছে, তেমনি আমাদেরও মনে রাখতে হবে, আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হলো জান্নাত। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘সেদিন যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে, সেই প্রকৃত সফলকাম।’ (সুরা আলে ইমরান ১৮৫) অর্থাৎ চূড়ান্ত সফল আমরা তখনই হতে পারব যেদিন তাকওয়া, ইখলাস ও ইবাদতের সাহায্যে পাথেয় সংগ্রহ করে আমরা জান্নাত লাভ করতে পারব।