তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা করছেন বা ফিচার সাংবাদিকতায় নিয়োজিত রয়েছেন কিংবা বোদ্ধা পাঠক, অর্থাৎ পড়ার কাজ যাদের অহরহ করতে হয় তাদের মধ্যে জেড-লাইব্রেরির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। এই গ্রন্থাগারটি বন্ধের অভিযানে মার্কিন অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এফবিআইকে তথ্য ফাঁস করে সহায়তা জুগিয়েছে গুগল ও ।
মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সম্মিলিত অভিযানের মধ্য দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে ১১ মিলিয়নের বেশি বই ও ৮০ মিলিয়নের বেশি নিবন্ধ ই-বই আকারের সংগ্রহশালা ছায়া গ্রন্থাগার প্রকল্প জেড-লাইব্রেরি। চলতি কথায়, নাটক-নভেল থেকে শুরু করে গবেষণামূলক পুস্তক বা সাময়িকীর বিনামূল্যের বিপুল উৎস ছিল এ গ্রন্থাগার। এর ওপর ভরসা করতেন ছাত্র, পাঠক ও গবেষকদের বিশাল একটি দল।
তৃতীয় বিশ্বে গবেষণা করছেন বা ফিচার সাংবাদিকতায় নিয়োজিত রয়েছেন কিংবা বোদ্ধা পাঠক, অর্থাৎ পড়ার কাজ যাদের অহরহ করতে হয় তাদের মধ্যে জেড-লাইব্রেরির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। আর এর কারণটি ছিল সহজ— “এ পাঠাগার ব্যবহার করা যেত বিনামূল্যে”। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই খুলে যেত বইয়ের বিশাল দুনিয়া।
জ্ঞানী অধ্যাপক বা জ্ঞানতাপসরা তার ছাত্রদেকে এ গ্রন্থাগারের ঠিকানা দিতে দ্বিধা করতেন না। বিশ্বের নামকরা পশ্চিমা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ এক অধ্যাপক প্রথম ক্লাসে ঢুকেই ছাত্রদের বলেন, তোমরা যারা এখনো পাঠ্য-পুস্তক কেনোনি তারা ঢুঁ মারতে পারো এখানে। তারপর বোর্ডে লাইব্রেরির ঠিকানা লিখে দিলেন। “How to Access Z Library using Tor?
- Download and install Tor on your computer. There are also apps on Android and iOS.
- Once Tor is opened, type “Z lib” into the default search engine, which should be DuckDuckGo.
- Click on the first result which is a . onion URL.
- Z-lib should now be accessible.”
Or, Website: “singlelogin.me zlibrary24tuxziyiyfr7zd46ytefdqbqd2axkmxm4o5374ptpc52fad.onion bookszlibb74ugqojhzhg2a63w5i2atv5bqarulgczawnbmsb6s6qead.onion”
পশ্চিমা পাঠ্যপুস্তক মোটেও সস্তা নয়। দামি। গলাকাটা দাম বললেও বোধহয় ঠিক হয়। কথিত ‘পাইরেটেড’ বা ‘চোরাই’ হওয়ার পরও প্রবীণ অধ্যাপক এ গ্রন্থাগারের কথা নিজ ছাত্রদের বলতে দ্বিধা করেননি। প্রসঙ্গত বলতে হয়, পশ্চিমা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গতিশীল ইন্টারনেট মাগনা, কিন্তু টরেন্টের মতো সাইটগুলো ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
এই গ্রন্থাগার বন্ধের অভিযানে মার্কিন অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এফবিআইকে তথ্য ফাঁস করে সহায়তা জুগিয়েছে গুগল ও অ্যামাজন। টরেন্ট ফ্রিকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অভিযানের অংশ হিসেবে জেড-লাইব্রেরি পরিচালনকারী রুশ দুই নাগরিকের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল এফবিআই। নজরদারির কাজ যতটা কঠিন হবে বলে মনে করা হয়েছিল ততটা হয়নি। হয়তো অ্যামাজন ও গুগলের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় অভিযানের এ অধ্যায় গরম কফিসহ নরম কেক খাওয়ার মতোই সহজ হয়ে গিয়েছিল। তল্লাশি চালানোর আদালতের সমন নিয়েই অভিযানে নামে এফবিআই। বিশ্বের বৃহত্তম ডিজিটাল গ্রন্থাগার পরিচালনকারী আন্তন নেপোলস্কি এবং ভ্যালেরিয়া এরমাকোভা তাদের পরিচয় সুরক্ষিত করাকে প্রয়োজনীয় মনে করেননি। নিজেরা কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাও গড়ে তুলেননি। গুগল ও অ্যামাজনের আশীর্বাদে তদন্তকারীরা দ্রুতই তাদের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে পারে। নেপোলস্কি ও এরমাকোভা উভয়কেই আর্জেন্টিনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শেষ অবধি তাদের আমেরিকায় ফেরত পাঠানো হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফাঁস করে দেওয়া তথ্য থেকে এফবিআই জানতে পারে যে, নেপোলস্কি বেশ কয়েক দফা জেড-লাইব্রেরির ডোমেইনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শনাক্তকরণ সম্ভব এমন ব্যক্তিগত ই-মেইল ঠিকানা এবং ফোন নম্বর ব্যবহার করেছেন। জেড-লাইব্রেরির ইমেইল ঠিকানাগুলোতে নেপোলস্কির ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে যোগসূত্র পাওয়া গেছে। জেড-লাইব্রেরির ই-মেইল zlibdoms@gmail.com নিবন্ধনের জন্য নিজ ই-মেইল Napolsky7@gmail.com এবং feedback.bookos@gmail.com ব্যবহার করেন তিনি।
গুগলের জোগান দেওয়া নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, Napolsky7@gmail.com নিবন্ধন করতে রাশিয়াভিত্তিক একটি টেলিফোন নম্বর যার শেষ চার সংখ্যা হলো ২৪৫৮ (নেপোলস্কির ১ নম্বর ফোন) ব্যবহার করা হয়।
একই বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় অ্যামাজন থেকে জোগান দেওয়া তথ্যে। অ্যামাজনে নেপোলস্কির দুটি অ্যাকাউন্ট ছিল। তিনি ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করেন। সেখান সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়ার ঠিকানা ব্যবহার করেন তিনি। তদন্তকারীরা আরও দেখতে পান যে নেপোলস্কি তার অ্যামাজনের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে কমপক্ষে ২১টি ক্রয়াদেশ দেন। এসব ক্রয়াদেশের মূল্য পরিশোধ করতে জেড-লাইব্রেরির সদস্যদের দান করা অ্যামাজন কিছু উপহার কার্ড ব্যবহার করেন তিনি। অ্যামাজন ক্লাউড হোস্টিং সেবা এডব্লিউএস থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতেও নেপোলস্কির সঙ্গে জেড-লাইব্রেরির সরাসরি যোগসাজশ পাওয়া যায়। তদন্তে উঠে আসে যে ডোমেইন @bookmail.org-এর সঙ্গে সরাসরি তার নাম ও ইমেইল আইডি যুক্ত রয়েছে। তদন্তকারীরা আরও জানতে পারেন, ক্রেতার কাছে বই পাঠাতে জে-লাইব্রেরি বুক মেইল ব্যবহার করা হয়েছে।
একইভাবে ‘ধরা খান’ ভ্যালেরিয়া এরমাকোভার। গুগল ও অ্যামজনের ফাঁস করা তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি জে-লাইব্রেরির সহকারী হিসেবে তৎপর। জেড লাইব্রেরির কোনো কোনো সদস্যের উপহার কার্ড দিয়ে কেনাকাটাও করেছেন তিনি। এখানে এফবিআইয়ের বিশেষ এজেন্ট ডোহনাল একটি নির্দিষ্ট কার্ডের বিবরণও তুলে ধরেন। গত বছর জানুয়ারি মাসে এ কার্ডটি দান করা হয়। দান করার পর জেড-লাইব্রেরি থেকে একটি বার্তাও দেওয়া হয় তাকে। তদন্তে আরও উঠে আসে যে এ বার্তাটি গেছে জেড-লাইব্রেরির ইমেইল ঠিকানা zlibsupp@gmail.com থেকে। অ্যামাজন যেসব তথ্য ফাঁস করেছে, এরমাকোভারকে ফাঁসানোর জন্য তা-ই যথেষ্ট। দান হিসেবে যা পেয়েছেন, তার সঙ্গে এরমাকোভার ইমেইল ও ক্রেডিট কার্ডের নথি থেকে পাওয়া তথ্যের সম্পর্ক রয়েছে। জেড-লাইব্রেরিতে দানের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করে অ্যামাজন থেকে কেনাকাটা করা হয়েছে। এসব পণ্যের বেশিরভাগই হলো পোশাক-আশাক ও সৌন্দর্য রক্ষা এবং বর্ধনে ব্যবহৃত সামগ্রী বলে দাবি করা হয়েছে।
২০১৯-এর ২০ মার্চ থেকে ১৫০২ একাউন্ট থেকে ১১০টি ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে। এসব ক্রয়াদেশের মূল্য ১৩,৬২৮.৩২ ডলার।
এদিকে গুগল যে তথ্য ফাঁস করে, তা থেকে জানা যায় কীভাবে জেড-লাইব্রেরির একটি আইপি অ্যাড্রেসের সঙ্গে এরমাকোভারকর ব্যক্তিগত ইমেইল ও জে-লাইব্রেরির ইমেইলে যোগাযোগ ছিল। অ্যামাজন ও গুগলের ফাঁস করা তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে জেড-লাইব্রেরির পরিচালনায় ছিলেন আন্তন নেপোলস্কি ও ভ্যালেরিয়া এরমাকোভা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, জেড-লাইব্রেরির জন্য যে অর্থ বা উপহার দান হিসেবে পাওয়া যেত, তা নিজেদের বিলাস-ব্যসনে ব্যয় করেন এই দুই রুশ নাগরিক। তবে অবাক করা বিষয় হলো, এই দুজনের কেউই নিজেদের পরিচয় গোপন করেননি। কিংবা নিরাপত্তার ওপরও তেমন গুরুত্ব দেননি। নিজেদের তৎপরতা গোপন রাখার চেষ্টাও তারা করেননি। এটা সত্যিই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে।