ম্যাচটা পিএসজি নিজেদের মাঠে খেলেনি, স্টেডিয়ামের নাম না জেনে থাকলে এমনটা কেউই ভাববেন না। অন্তত লিওনেল মেসি যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, ততক্ষণ!
রেঁসের মাঠে কাল পিএসজির জার্সিতে প্রথমবার মাঠে নেমেছেন মেসি। বার্সেলোনার অধ্যায় শেষে পিএসজিতে যোগ দেওয়া মেসিকে এই প্রথম ক্লাব ক্যারিয়ারে বার্সা ভিন্ন অন্য কোনো জার্সিতে দেখা গেল। বার্সার জন্য সেটি আফসোসের, কিন্তু পিএসজির জন্য তো আনন্দের। ক্লাব নির্বিশেষে ফ্রান্সের ফুটবলপ্রেমীদের জন্যও কী নয়?
কাল রেঁসের সমর্থকেরাই যে মেসির জন্য করতালি দিয়ে গেছেন প্রতিটি মুহূর্তে, বলে মেসির প্রতিটি স্পর্শে। দেখে যে কারও মনে হতেই পারে, ম্যাচটি বুঝি নিজেদের মাঠেই খেলছে পিএসজি!

দুই অর্ধে কিলিয়ান এমবাপ্পের দুই গোলে পিএসজি ম্যাচটা ২-০ গোলে জিতেছে। ৬৬ মিনিটে নেইমারের বদলি হয়ে নেমেছেন মেসি। কেমন খেলেছেন ৩৪ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন?
সাদা চোখে, বিশেষ কিছু করতে পারেননি মেসি। গোল তো করতেই পারেননি, গোলে সহায়তাও নয়। তিনি মাঠে নামার আগেই পিএসজির দুই গোল হয়ে গিয়েছিল।
আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৬৩ মিনিটে এমবাপ্পে নিজের ও পিএসজির দ্বিতীয় গোলটি করার পরই মেসিকে নামান পিএসজি কোচ মরিসিও পচেত্তিনো। নির্ধারিত সময়ের ২৪ মিনিট ও যোগ করা ৬ মিনিট সময় মিলিয়ে ৩০ মিনিট মাঠে ছিলেন মেসি, তেমন কোনো আক্রমণও গড়তে পারেননি।
দু-একবার এমবাপ্পের সঙ্গে সমন্বয় করে রেঁসের বক্সে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কখনো মুখে রেঁসের ডিফেন্ডারের হাতের আঘাতে মাটিতে পড়ে গেলেন, কখনো রেঁসের তিন-চার ডিফেন্ডার তাঁকে ঘিরে ধরায় সামনে এগোনোর পথ ছিল না মেসির। তিনি মেসি বলেই হয়তো ওই অবস্থায়ও বেশির ভাগ সময়েই অবশ্য বলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছিলেন!
তবে গোলমুখে তেমন ‘মেসি-সুলভ’ কিছু করতে না পারলেও বলে তাঁর প্রতিটি স্পর্শই বুঝিয়ে দিয়েছে, কেন তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। প্রথম দিনে সবকিছু হয়তো সাধারণ-সরল-স্বাভাবিকই রাখতে চেয়েছিলেন। মূলত মাঝবৃত্তের আশপাশেই খেলেছেন মেসি। কখনো ভেরাত্তি, কখনো আন্দের এরেরা, কখনো ইদ্রিসা গানা গেয়ের সঙ্গে ওয়ান-টু খেলেছেন। দারুণ নিয়ন্ত্রিত সব পাসে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাতেই তাঁর যত মনোযোগ ছিল।
এমবাপ্পের সঙ্গেও দু-তিনবার সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এতটুকু বোঝা গেছে, এখনো পুরো ৯০ মিনিট খেলার মতো ফিট না হওয়া মেসির সঙ্গে এমবাপ্পের সমন্বয় হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। মানে, গুঞ্জনকে একপাশে রেখে এমবাপ্পে যদি রিয়াল মাদ্রিদে না যান আর কি!
টুইটে ফুটবলের পরিসংখ্যান বিষয়ক একাউন্ট স্কোয়াকা জানাচ্ছে, ৩০ মিনিটে মোট ২১টি পাস দিয়েছেন মেসি, এর মধ্যে ২০টিই সতীর্থকে খুঁজে নিয়েছে। ২৬ বার বলে পা ছুঁইয়ে ছেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। ৩০ মিনিটেই ফাউলের শিকার হয়েছেন ৩ বার।
একবার রেঁসের অর্ধে রেঁসেরই ডিফেন্ডার আবদেলহামিদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়েছেন, বলতে গেলে পেছন থেকে ছুটে এসে বল ‘চুরি করে নিয়েছেন!’ সেখান থেকে কয়েক পদক্ষেপের ছোট আঁকাবাঁকা দৌড়ের পর ডানদিকে ছুটতে থাকা এমবাপ্পেকে পাসও দিয়েছিলেন মেসি, কিন্তু এমবাপ্পের ফিরতি পাস বক্সে মেসির কাছে যাওয়ার আগেই রেঁস ডিফেন্ডার বিপদমুক্ত করেন।
জুলাইয়ে আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জেতানোর পর ছুটি ও বার্সেলোনায় চুক্তি নবায়ন নিয়ে ঝামেলার মধ্যে অনেক দিন অনুশীলনের বাইরে ছিলেন মেসি। বার্সেলোনায় চুক্তি নবায়ন করে আগস্টের শুরুতেই কাতালান ক্লাবটির হয়ে অনুশীলনে নামার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে হঠাৎ একদিনের মধ্যে ঘটনায় ১৮০ ডিগ্রি বদলে যায়।
যেদিনে বার্সেলোনায় মেসির চুক্তি সই করার কথা ছিল, সেদিনের শেষে এসে উল্টো বার্সা জানিয়ে দেয়, মেসির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন সম্ভব হচ্ছে না, মেসি আর বার্সায় থাকছেন না। ৫ আগস্ট বার্সার ওই ঘোষণার তিন দিন পর পিএসজিতে যোগ দেন মেসি। এরপর অনুশীলন শেষে গতকালই প্রথম মাঠে নামা তাঁর।

পিএসজি কোচ পচেত্তিনো ম্যাচ শেষে বললেন, ‘মেসির শুরুর দিনে আমাদের জেতাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ও দলে একটা স্থিরতা নিয়ে আসে। ওর ঝলক, ওর তৎপরতা দলের বাকিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।’
মেসি মাঠে নামবেন বলেই রেঁস সমর্থকদেরও কী উত্তেজনা! যে রেঁসের আগের ম্যাচে মেরেকেটে ৯ হাজার দর্শক হয়নি, কাল মেসির কারণেই ২০ হাজার ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামের পুরোটাই ভর্তি! শুরুতে বেঞ্চে থাকা মেসি ৫৭ মিনিটে গা গরমের জন্য বেঞ্চ ছেড়ে উঠলেন, রেঁস সমর্থকদের সে কী আনন্দ তখন! মেসি যে পিএসজির আর পিএসজি যে তাদের প্রতিপক্ষ সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে ‘মেসি’, ‘মেসি’ কোরাস ধরলেন! মেসি ভালোবাসার জবাব দিলেন দুই দলের সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নেড়ে।
৬৬ মিনিটে নেইমারের বদলি হয়ে মেসি মাঠে নামতেই স্টেডিয়ামে গগনবিদারী উল্লাস। মেসি ফ্রান্সের ফুটবলে প্রথমবার নামছেন বলে কথা! বলে মেসির প্রতিটি স্পর্শেই পিএসজি সমর্থকেরা তো বটেই, রেঁস সমর্থকেরাও উচ্ছ্বাস দেখালেন। রেঁস-পিএসজি ভুলে তাঁরা তখন মেসির সমর্থক।
শুধু কী সমর্থক? রেঁসের খেলোয়াড়েরাও ম্যাচের পর মেসির সঙ্গে ছবি তুলতে লাইন ধরলেন। গোলকিপার পেদ্রাগ রাইকোভিচ তো শিশু ছেলেকেও নিয়ে এলেন, মেসি শিশুটিকে কোলে তুলে ছবি তুললেন। রেঁস ডিফেন্ডার অ্যান্ড্রু গ্রাভিয়ন রয়টার্সে বললেন, ‘ও অসাধারণ। গত বছর পর্যন্ত ওকে শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে দেখতাম, এখন ওকে আমাদের লিগে পাচ্ছি। ওর সঙ্গে বলের দখলে নামাও তো দারুণ গর্বের।’
মেসির জার্সি চেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপও আছে গ্রাভিয়নের, ‘ম্যাচ শেষে ওর কাছে গিয়েছিলাম আমি। আমার ছোট ভাইয়ের জন্য ওর জার্সিটা চেয়েছিলাম। কিন্তু ও আমাকে দিতে পারেনি। দেখা যাক, হয়তো পরেরবার পাব।’
গ্রাভিয়নের ভাগ্য খারাপ। পিএসজির জার্সিতে মেসির অভিষেক জার্সিটার চাহিদা যে অনেক বেশিই হওয়ার কথা। কে জানে, মেসি নিজেই হয়তো প্রথমের স্মৃতি ধরে রাখতে জার্সিটা কাউকে না দিয়ে নিজের কাছেই স্মারক হিসেবে রেখে দিচ্ছেন!