বিগত বছরগুলোর মতো এবারও দেশের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলছেন, বাজেট গতানুগতিক। এখানে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই। আবার কেউ বলছেন, বাজেট সময়োপযোগী হয়েছে।
একদিকে করোনা মহামারি, অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর চলছে। এবারের বাজেট ছিল দেশের ৫০তম বাজেট। এমন অবস্থায় এবারের জাতীয় বাজেট নিয়ে মানুষের মধ্যেও ছিল বিপুল আগ্রহ। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আজ শনিবার সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ১৫ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের অধিকাংশ জানান, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের অগ্রাধিকারগুলো বদলে গেছে। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বাজেট করা গেলে আরও ভালো হতো। ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হলেও মধ্যবিত্তরা হতাশ। অথচ করোনাকালে মধ্যবিত্তরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে। স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক বেষ্টনী খাত এবং দুর্যোগ ব্যবস্থা খাতে আরও বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন ছিল বলেও অনেকেই অভিমত দিয়েছেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক জহিরুল হক শাকিল বলেন, করোনা সংকটের উন্নতি না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানি খাত চাঙা না হলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানির বহুমুখী ব্যবহারের ওপর যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
অধ্যাপক জহিরুল হক আরও বলেন, ব্যবসাবান্ধব বাজেটের নামে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন কর আদায়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করা হয়েছে। এমনিতেই দেশের অনেক ব্যবসায়ী সময়মতো ভ্যাট প্রদানে উৎসাহী নন, সে ক্ষেত্রে সময়মতো ভ্যাট রিটার্ন না দিলে জরিমানার পরিমাণ কমানো ও ভ্যাটের টাকার ওপর সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা বুমেরাং হতে পারে। তবে আমদানিতে আগাম ভ্যাটের পরিমাণ কমানোয় সুফল আসতে পারে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দে মোট বাজেটের অংশ না বাড়িয়ে বরং আরও কমাচ্ছে। এটি দেশের পরিবেশ রক্ষায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলবে। টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলাভূমি-নদী ও সাগরের বাস্তুসংস্থানের টেকসই ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ কমেছে, যা হতাশাব্যঞ্জক।
আশরাফুল কবীর, ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা যখন জলবায়ু পরিবর্তনকে মহাবিপদ বলে অভিহিত করছেন, তখন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দে মোট বাজেটের অংশ না বাড়িয়ে বরং আরও কমাচ্ছে। এটি দেশের পরিবেশ রক্ষায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলবে। টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলাভূমি-নদী ও সাগরের বাস্তুসংস্থানের টেকসই ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ কমেছে, যা হতাশাব্যঞ্জক। তবে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানো, টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর খাতে বাজেট সামান্য হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক।
প্রকাশনা সংস্থা চৈতন্যের স্বত্বাধিকারী রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় বাজেটে কখনোই সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশনা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এবার করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত এই শিল্পের প্রতি আলাদা বরাদ্দ প্রত্যাশা করেছিলাম। অথচ সম্ভাবনাময় এই শিল্প সব সময়ের মতোই উপেক্ষিত। নানা রকম প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলেও সৃজনশীল কাজের প্রতি স্বস্তি ও পরিধি বাড়াত।’
নারী উদ্যোক্তা নাজমা পারভীন বলেন, করোনাকালে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, এটি আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে এই সেবা পৌঁছাবে কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেল। ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক লেনদেন ৭০ লাখ পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, এটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সুফল পাচ্ছেন না। দেশীয় শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা স্বনির্ভর দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে।
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কান্তি দেব বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাতে যেখানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের প্রত্যাশা করেছিলাম, সেটা পূরণ হয়নি। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, অথচ দাবি ছিল অন্তত ২০ শতাংশের। আবার বেকারত্ব দূরীকরণ কিংবা কর্মসৃজন ক্ষেত্রে বরাদ্দও হতাশ করেছে। বর্তমান সময়ে এ দুটি খাতই সবচেয়ে গুরুত্বের দাবি রাখে।