বঙ্গোপসাগরের গভীরে অবস্থিত জায়গাটির সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ‘SONG’। যাকে বৃহৎ করলে দাঁড়ায় ‘Swatch of No Ground’ অর্থাৎ ‘যার কোন তল নেই’। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড হচ্ছে ১৪ কিলোমিটারব্যাপী বঙ্গোপসাগরের তলায় একটি গভীর উপত্যকা বা মেরিন ভ্যালি। একে আন্ডার ওয়াটার ক্যানিয়নও বলা হয়।
প্রায় ৩ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার এরিয়াজুড়ে এটি বিস্তৃত। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে এটি বিশ্বের সেরা ১১টি গভীর খাদ বা ক্যানিয়ন এর মাঝে অন্যতম। অনেকে এটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গভীর খাদও বলে থাকেন। গঙ্গা -ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরেরর ভেতরে একটি গভীর খাদের মত জায়গা। এটি গঙ্গা খাদ নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার বছর আগে এই গিরিখাতের সৃষ্টি। বিজ্ঞানীদের মতে, এটি একটি সামুদ্রিক অভয়ারণ্য। বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে এই স্থানটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এর নাম করণ নিয়ে রয়েছে একটি রহস্যময় ইতিহাস। ১৮৬৩ সালে গ্যাডফ্লাই নামে ২১২ টন ওজনের একটি ইংরেজ গানবোট ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে বিপুল ধনরত্নসহ পাড়ি দেবার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে এই স্থানে ডুবে যায়। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বোটটার খোঁজ না পেয়ে এর এমন নামকরণ করেন।
বাংলাদেশের দক্ষিণে সুন্দরবনের শেষ প্রান্ত থেকে আরো ১৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই মিলবে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির দেখা। এখানে হুট করেই জল ক্রমশ গভীর নীল হতে দেখা যায় এবং জলের গভীরতাও অস্বাভাবিক বেশি। স্থানীয় জেলেদের কাছে স্থানটি ‘নাই বাম’ হিসেবে পরিচিত। বাম হচ্ছে জেলেদের পানির গভীরতা মাপার নিজস্ব পদ্ধতি। নাই বাম মানে হচ্ছে কোন গভীরতা নেই।
বিরল জীব বৈচিত্র:
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরের বিরল জীব বৈচিত্র্যের নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র। অনুসন্ধানে এখানে এমন কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব মিলেছে যেগুলো বিশ্বে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের তালিকায় রয়েছে। এলাকাটি তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর ও কচ্ছপের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র। বাংলাদেশের সেরা চিংড়ির ঘের এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে অবস্থিত।
এটি পৃথিবীর একমাত্র সোয়াচ যেখানে ইরাবতী ডলফিন, ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন ও পাখবাহীন ইমপ্লাইস ডলফিন এই তিনটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একসঙ্গে দেখা যায়। এখানে পানির কাছাকাছি সী-গাল পাখির অবস্থান দেখে বুঝতে পারবেন ডলফিন এবং তিমির অবস্থান। তিমির মধ্যে এখানে দেখতে পাবেন ব্রীড তিমি ও মিল্কি তিমি। দৈত্যাকার তিমির উপস্থিতি মুহূর্তে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও সৃষ্টির এমন রহস্য কাছ থেকে দেখে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবানই মনে হবে। এছাড়া সামুদ্রিক রহস্যময় জীব জগতের মধ্যে এখানে দেখতে পাবেন প্রায় ১০ প্রজাতির পাখি, ৩০ প্রজাতির মাছ সহ আরো নানা জাতের প্রাণী।
যেভাবে যাবেন :
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড মংলা/ সুন্দরবন এর দুবলার চর/সোনারচর থেকে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে সরাসরি মংলা। মংলা থেকে প্রতিদিনই মাছ ধরার ট্রলার যায় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে। জেলেদের সাথে কথা বলে উঠে পড়বেন যেকোন একটি ট্রলারে। রাতে মাছ ধরার জন্য ট্রলারগুলো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। বিস্তারিত জেনেই ট্রলারে চড়বেন। এছাড়া মংলা বন্দরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন, যদি জাহাজে করে যাবার কোন সৌভাগ্য এবং সুযোগ মিলে কিনা।
সতর্কতা :
দয়া করে সমুদ্রে কোন বর্জ্য নিক্ষেপ করবেন না। প্ল্যাস্টিক কিংবা অপচনশীল দ্রব্য সংগ্রহে রেখে উপযুক্ত স্থান দেখে পেলুন। সমুদ্রে যেতে অবশ্যই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নেবেন।