হ্যাটট্রিক করে কিংবদন্তি পেলেকে ছাড়িয়ে গেলেন মেসি

দিনটা এমনিতেই বিশেষ ছিল। বলিভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে এস্তাদিও মন্যুমেন্তালের দর্শকদের সামনে কোপা আমেরিকার শিরোপা তুলে ধরার কথা ছিল আর্জেন্টিনার। রেকর্ড গড়ার জন্য যেন সেই দিনটাকেই বেছে নিলেন লিওনেল মেসি। ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছুঁলেন, ভাঙলেন, এরপর পেয়ে গেলেন হ্যাটট্রিকও। তাতে বলিভিয়ার বিপক্ষে গতকাল ৩-০ গোলের দারুণ এক জয়ই পেল আলবিসেলেস্তেরা।

২৮ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হয়েছে মাসদুয়েক আগে। তবে আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয়ের পরও কোথাও যেন একটু অতৃপ্তি ছিল অধিনায়ক মেসির। এইতো গতপরশুই ইএসপিএন আর্জেন্টিনাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন সে কথা, দর্শকদের সামনে শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে না পারার আক্ষেপের কথা।
সে আক্ষেপের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিতেই হয়তো, ভক্তসমর্থকদের সামনে শিরোপা উঁচিয়ে ধরার কথা মেসিদের। এমন দিনে প্রয়াত কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকেও ভোলেননি এস্তাদিও মন্যুমেন্তালের ১৭০০০ দর্শক, বেঁচে থাকলে তার চেয়ে বেশি খুশি কে হতেন আর্জেন্টিনায়! ম্যাচের দশম মিনিটে দাঁড়িয়ে অভিবাদন, আর করতালির মাধ্যমে প্রয়াত কিংবদন্তিকে স্মরণ করে আলবিসেলেস্তে ভক্তরা।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শিরোপা যেমন মিলেছে, করোনার চোখরাঙানি এড়িয়ে দীর্ঘদিন পর মাঠে আসার অনুমতি পেয়েছেন দর্শকরাও। দুটো যখন মিলে গেল এক বিন্দুতে, তখন সেটা যেন বড় অনুপ্রেরণাই দিল আর্জেন্টিনাকে। কোচ লিওনেল স্ক্যালোনির শিষ্যরা সাঁড়াশি আক্রমণে শুরু থেকেই চেপে ধরল বলিভিয়াকে। পুরো ম্যাচের ৭০ শতাংশ সময় বল ধরে রেখেছেন মেসিরা, প্রতিপক্ষ গোলমুখে নিয়েছেন ২৪টা শট। প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক কার্লোস লাম্পে যদি দেয়াল হয়ে না দাঁড়াতেন, তাহলে গোলের সংখ্যাটা আরও বাড়ত বৈকি!
তবে লাম্পের দেয়াল ভাঙতে অতিমানব মেসি সময় নেননি খুব একটা। ১৪ মিনিটেই দারুণ এক দূরপাল্লার শটে গোল পেয়ে যান তিনি। তাতে ছুঁয়ে ফেলেন পেলের গড়া দক্ষিণ আমেরিকায় সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলের রেকর্ডও। বিরতির আগে লাওতারো একবার বল জড়িয়েছিলেন জালে। তবে অফসাইডের কাটায় পড়ে গেল সেটা। বিরতির বাঁশি বাজার আগে মেসি নষ্ট করলেন একটা সুযোগ, লাওতারোও করলেন একটা। তাতে বিরতিতে এক গোলে এগিয়ে থেকেই যেতে হয় দলটিকে।
রেকর্ড ছোঁয়া হয়ে গিয়েছিল প্রথমার্ধেই। কিন্তু সেটা ভাঙা যে বাকি রয়ে গিয়েছিল! সে অসমাপ্ত কাজটাই মেসি সারলেন দ্বিতীয়ার্ধে। ৬৪ মিনিটে সতীর্থ লাওতারোর পাস থেকে করলেন দ্বিতীয় গোলটা। তাতেই রেকর্ডটা এসে লুটিয়ে পড়ল মেসির পায়ে। পেলেকে সরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে আসীন হন রেকর্ড ছয় বারের ব্যালন ডি অর বিজয়ী।
প্রথমার্ধের শেষ দিকে মিসটা না করলে হয়ে যেত হ্যাটট্রিকটাও। তবে সে আক্ষেপটাও মেসি পুষে রাখলেন না দিনটিতে, ৮৮ মিনিটে পেয়ে গেলেন সেই পরম আরাধ্য হ্যাটট্রিকটা। এর আগেও আর্জেন্টিনার মাটিতে একটা হ্যাটট্রিক ছিল তার, কিন্তু সেটা অবশ্য ছিল প্রীতি ম্যাচে, পুঁচকে হাইতির বিপক্ষে। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে এটাই প্রথম। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দুটো হ্যাটট্রিক গড়ে আর্জেন্টাইন রেকর্ডটাও নিজের করে নিয়েছেন সাবেক বার্সেলোনা তারকা।
ম্যাচ শেষের সাক্ষাৎকারেও আবেগ লুকাতে পারেননি মেসি। ম্যাচ দেখতে মাঠে উপস্থিত ছিলেন মেসির মা-ভাই। তারাও উৎসবে যোগ দিলেন। সাক্ষী হলেন কীভাবে সবাইকে ছাড়িয়ে লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ গোলাদাতার মুকুট পরলেন ঘরের ছেলে। নিজের মাঠে এই উদযাপন করতে পেরে মেসি নিজেও খুশি, ‘মনুমেন্টালে এই রেকর্ডটা উদযাপন করতে পারছি, এর থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। আমার মা ও ভাই স্ট্যান্ডে আছেন, তারা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তারা আজ আমার জন্য উদযাপন করছেন। আমি অনেক খুশি।’
পেলেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ডটা গড়া যে মেসির স্বপ্ন ছিল, সেটাও লুকাননি মেসি, ‘আমি আসলেই এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চেয়েছি। আমি এই রেকর্ডটা নিজের করে নিতে চেয়েছি। রেকর্ডটা ভাঙার স্বপ্ন দেখেছি। অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে রেকর্ডটা আমার হয়েছে। অসাধারণ এক মুহূর্ত এটা।’
এত সব কীর্তি নিজের মাঠে, নিজের দর্শকদের সামনে গড়েছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক মেসি। দলও পেয়েছে ৩-০ গোলের দারুণ এক জয়। তাতে আর্জেন্টিনার ‘বিশেষ’ দিনের মাহাত্ম্য বেড়েছেই কেবল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *