মালিকপক্ষের নতুন মজুরি প্রস্তাবের প্রতিশ্রুতির পরও থামছে না তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন। গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানীর মিরপুর, গাজীপুর ও আশুলিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে।

পুলিশ বলেছে, পোশাকশ্রমিকেরা মিরপুরে কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেছেন। তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে পুলিশ কর্মকর্তাসহ কয়েকজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে। গাজীপুরে শ্রমিকেরা মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাঁদের সরিয়ে দেয়। আশুলিয়ায় শ্রমিকেরা একটি কারখানার ফটক ভেঙে গ্যারেজে থাকা দুটি গাড়ির কাচ ভাঙচুর করেন।

পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় গতকাল আরও দুই শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকেরা। শিল্প পুলিশ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, গত তিন দিনে বন্ধ কারখানার সংখ্যা ৬৫০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে মিরপুরে ২৩৫টি, আশুলিয়ায় ৩৫টি এবং গাজীপুরের ৩৮৬টি কারখানা রয়েছে।

শ্রমিকদের মজুরি ও আন্দোলনের বিষয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান গতকাল বিকেলে ১৪ জন শ্রমিকনেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনে বৈঠক শেষে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মালিকদের ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব অযৌক্তিক। মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) মজুরি বোর্ডের পরবর্তী সভা হবে। সেই সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন বলে জানান।

শ্রম প্রতিমন্ত্রীর কাছে শ্রমিকনেতারা তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য গ্রহণযোগ্য মজুরি, মোট মজুরির ৬৫ শতাংশ মূল বেতন, বার্ষিক ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট এবং ৭টির বদলে ৫টি গ্রেড নির্ধারণের দাবি জানান।

সভায় অংশ নেওয়া ১৯টি শ্রমিক সংগঠনের জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সভাপতি আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব পোশাকশ্রমিকদের জন্য যুক্তিসংগত মজুরি নির্ধারণ করা দরকার। পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কার্ডের মাধ্যমে নিত্যপণ্য রেশন হিসেবে দেওয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন। এসব পদক্ষেপ ছাড়া গায়ের জোরে শ্রমিকের আন্দোলন বন্ধ হবে না।

চলতি বছরের এপ্রিলে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে সরকার নিম্নতম মজুর বোর্ড গঠন করে। গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেন। বিপরীতে মালিকপক্ষ প্রায় অর্ধেক বা ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেয়।

পরদিন থেকেই গাজীপুরে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। পরে আশুলিয়া-সাভারেও শ্রম অসন্তোষ ছড়ায়। গত সোমবার গাজীপুরে দুজন শ্রমিক নিহত হন। পরদিন আন্দোলন আরও সহিংস হয়ে উঠলে বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, মালিকেরা চাইলে কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। তারপরই অনিবার্য কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ করা শুরু করেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।

অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিম্নতম মজুরি বোর্ডে নতুন করে প্রস্তাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও কেন আন্দোলন হচ্ছে, সেটির যৌক্তিক কারণ আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। চারদিক থেকে বিভিন্ন পক্ষ উসকানি দিয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামাচ্ছে। রাজনীতিও ঢুকে গেছে মনে হচ্ছে।’

ফারুক হাসান আরও বলেন, শনিবার থেকে সব কারখানা খুলবে। সেদিন থেকে শ্রমিকেরা যদি কাজ না করেন এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে, তাহলে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অর্থাৎ ‘কাজ নেই, বেতন নেই’ ভিত্তিতে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। আশা করি, শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণভাবে উৎপাদন চালিয়ে যাবেন।

রাজধানীর মিরপুরে পূরবী সিনেমা হলের সামনে গতকাল পুলিশের সঙ্গে পোশাকশ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। পুলিশ বলেছে, পোশাকশ্রমিকেরা মিরপুরে বিআরটিসির বাসের ডিপোতে ঢুকে কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেছেন। সন্দেহভাজন তিন–চারজনকে আটক করা হয়েছে।

সকাল আটটার দিকে পোশাকশ্রমিকেরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মিরপুর-১০ নম্বর থেকে মিরপুর-১১ ও ১২ নম্বরের দিকে যান। বেলা ১১টার দিকে পুলিশের সঙ্গে পোশাকশ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এ সময় শ্রমিকদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। ইটে পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মাসুক মিয়ার গাড়ির কাচ ভেঙে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী আবুল হালিম বলেছেন, সকাল থেকেই রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলেন পোশাকশ্রমিকেরা। একপর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। তখন পুলিশ এগিয়ে গিয়ে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এরপর শ্রমিকেরা বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যান।

মিরপুর অঞ্চলের পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মিরপুরে ২৩৫টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা গতকাল বন্ধ ছিল। শনিবার থেকে কারখানাগুলো খুলতে পারে বলে জানান তিনি।