জাপান কেন এত পরিষ্কার

 

জাপানের পরিচ্ছন্নতার রহস্য
জাপান এতো পরিষ্কার কেনো?
আসলেই তো জাপানের শহর গুলো এত এত পরিষ্কার কেন?
উত্তর অনেকগুলো। তবে সোজা উত্তরটি হল- জাপানিরা নিজেদের শহর নিজেরাই পরিষ্কার রাখেন। নাহ ঠিক হলোনা। শুধু জাপানিরাই নন, জাপানে বসবাসরত বিদেশিরা ও রাখেন।
কেমন যেন একটা পরিবেশ।
বাংলাদেশে এই আমরাই যা করিনা, জাপানে এসে সেই আমরাই এখানকার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিধানগুলো মেনে চলি। পরিবেশ বাধ্য করে। পরিবেশটা একদিনে তৈরি হয়নি রে ভাই।
কিছুটা ইতিহাস কিছুটা কল্পনা দিয়ে আজকের কাহিনি।
১) সিজুকার মা, নবিতার মা সিন্ড্রোম
জাপানের টি,ভি তে দেখা কাহিনি। ১৯৬০ সালের দিকে টোকিওর অবস্থা ছিল অনেকটা বর্তমান ঢাকা শহর বা নব্বই দশকের ব্যাংককের মতই। সবাই যত্র তত্র ঘরের আবর্জনা ফেলত। রাস্তার পাশে, বিদ্যুৎ পিলারের গোড়ায়। সেই ময়লা কাক, বিড়াল, কুকুর আধা খেয়ে আধা এদিক সেদিক ছড়িয়ে দিত।
একসময় জাপান সরকার পাড়ায় পাড়ায় ময়লা ফেলার জন্য নির্দিস্ট জায়গা ও সময় নির্ধারন করে দিলেন। ময়লার গাড়ি ঘড়ি ধরে ময়লা সংগ্রহ করে নেবে এটাই ছিল প্ল্যান। কিন্তু এতে কাজ হলো না। করিমের মা রহিমের মা থুক্কু সিজুকার মা, নবিতার মা টাইপের দ্বন্দ্ব শুরু হলো।
ধরুন সিজুকার বাবা বেঠিক সময়ে বেঠিক জায়গায় ময়লা ফেললেন। কেউ দেখে ফেললেই সিজুকার মা চেঁচিয়ে ওঠেন- পাশের বাড়ির নবিতার বাপ যখন ফেলে, তখন আপনারা চোখে দেখেন না? শুধু আমরা ফেললেই দোষ।
নিজের দোষ আরেকটা দোষের সাথে তুলনা করে হালাল করে নেবার চেষ্টা জাপানিদের মধ্যে ও ছিল। এই সিন্ড্রোম এর নাম দিলাম নবিতার মা সিজুকার মা সিনড্রোম।
সরকার কতজন সিজুকার মার কমপ্লেইন শুনবেন?
পন্থা পালটালেন। সবার মগজে ঢুকিয়ে দিলেন এক ধরনের প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশের মত জাপানিদের মধ্যে ও একটা মেহমানপ্রীতি ভাব আছে। সেটাকে কাজে লাগানো হল। আচরণ পরিবর্তন করার পরিবেশ ডিজাইন। আমি একে বলি আচরণ ডিজাইন। কি বোঝানো হল জানেন?
শুন ওগো নবিতার মা শুন দিয়া মন
৪ বছর পর অলিম্পিক, ঘটবে বিদেশির আগমন
ঘরের কোণা রাস্তার কোণা রাখতে হবে গো পরিষ্কার
একটু খানি ময়লা থাকলে গো মা, ইজ্জতের কারবার
নিজেদের মধ্যে ইজ্জত গেলে পাড়ার বদনাম। কিন্তু বিদেশিদের সামনে ইজ্জত গেলে পুরো দেশের বদনাম। পাড়ায় পাড়ায় লিডার বানানো হল। অনেকটা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের গ্রুপ লিডার দের মত। প্রতিযোগিতা শুরু হল কার পাড়া কত সুন্দর। লিডারদের উৎসাহ দেয়া হল। সবাইকে বলা হল আপনার পাড়া সবচেয়ে পরিষ্কার।

কোন পেনাল্টির ভয় দেখানো হলোনা, কোন রকম পুরস্কারের ঘোষণা ও করলো না, শুধু উৎসাহতে কাজ হলো।

জাপান
জাপানের রাস্তা

৬৪ সালে সুন্দর পরিস্কার টোকিও শহরে অলিম্পিক হলো। সবাই খুশি। মানুষ অভ্যাসের দাস। পাড়া পরিস্কার রাখার অভ্যাস এই যে একবার তৈরি হল, সেটাই বজায় রইল। আজকে যেই পরিষ্কার জাপান দেখেন, তার কর্মসুচি শুরু হয়েছিল অলিম্পিককে লক্ষ্য করে। প্রায় ৬৬ বছর আগে।

২) ময়লা নিয়ে গবেষণা
অভ্যাস তৈরি হবার পর সরকার থেমে রইলেন না। পরবর্তি স্টেপে হাত দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সাথে কথা বললেন। ময়লা সংগ্রহ করা থেকে ডাম্প করা পর্যন্ত পুরো প্রসেস টাকে কিভাবে ইফিসিয়েন্ট করা যায় সে নিয়ে গবেষণার জন্য অনুরোধ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগন ইউরোপ গেলেন, আমেরিকায় গেলেন। সেই দেশে কিভাবে শহর পরিষ্কার রাখেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন। গবেষণার রিপোর্ট আর নিজেদের সংস্কৃতির সাথে বিবেচনা করে তৈরি করলেন আরবান ওয়েইস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান। দায়িত্ব দেয়া হল সিটি কর্পোরেশন কে। ইউনিক ইউনিক কিছু নিয়ম নীতিমালা বেরিয়ে এল। সারমর্মটা এমন –
[রুল-১] ময়লা তৈরি করবে যে, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করবে সে।
[রুল-২] ময়লা তৈরি যেখানে, সংগ্রহ করো সেখানে ।
ধরুন কেউ যদি কোকাকোলার ক্যান কেনেন, তাহলে সেই ক্যান সংগ্রহ করে রিসাইকল করার দায়িত্ব কোকাকোলা কোম্পানির (রুল-১)। ভোক্তা যেখানে ক্রয় করবে, সেখানেই ক্যান ফেলার জায়গা তৈরি করে দেবে একই কোম্পানি (রুল-২)।
এমন রুল জারি করার নেপথ্য কাহিনিটা মজার। ৮০ সাল থেকে জাপানে ড্রিঙ্কস ক্যান আর প্লাস্টিক বোতলের এর ব্যবহার বেড়ে গেল। বিশেষ করে ড্রিঙ্কস কোম্পানি গুলো পাড়ায় পাড়ায় ভেন্ডিং মেশিন বসিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করলেন। যাদের জাপানের ভেন্ডিং মেশিন সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের বলছি, অনেকটা স্টিলের আলমারির মত একটা বাক্স। হরেক রকমের পানীয় থাকে। একটা রোবট চালিত মুদির দোকান বলতে পারেন। পয়সা ঢুকিয়ে দিয়ে পণ্য সিলেক্ট করবেন, অটমেটিক্যালি বেরিয়ে আসবে, খুচরা পয়সা ফেরত আসবে। এখন গরম চা, কফি, নিউজ পেপার, কনডম, এডাল্ট ভিডিও, চাল, খাবার দাবার ও বিক্রি হয়।
জাপানে অটোমেটিক ভেন্ডিং মেশিনের সংখ্যা হল ৫৫ লাখ। জনসংখ্যা ১২ কোটি। প্রতি ২১ জন মানুষের জন্য একটা করে ভেন্ডিং মেশিন। ২০১৫ সালে শুধু ভেন্ডিং মেশিন থেকে পণ্য বিক্রি হয়েছে ৭ ট্রিলিয়ন ইয়েন (মানে ৪ ট্রিলিয়ন টাকার মত, বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেট হল ৩ ট্রিলিয়ন টাকা)। সারা বাংলাদেশে আমরা একবছরে যতটাকা ব্যয় করি, জাপানিরা শুধু ভেন্ডিং মেশিনের ড্রিঙ্কস কিনেই তার চেয়ে বেশি করে। বোঝেন কত বড় ব্যবসা। দিনে প্রায় ১৬০ মিলিয়নটা পণ্য বিক্রি হচ্ছে এই ভেন্ডিং মেশিন গুলো থেকে। তার মানে তত গুলো ক্যান আর প্লাস্টিক বোতলের আবর্জনা। অন্যান্য আবর্জনার মত ক্যান, প্লাস্টিক বোতল পোড়ানো যায়না। প্লাস্টিক পোড়ালে ডাই-অক্সিন তৈরি হয়, পরিবেশের জন্য খুব খারাপ । বিশেষ করে পুরুষ প্রাণীদের যৌন ক্ষমতা লোপ পায়- জিনিসের সাইজ ছোট হয়ে আসে। জাপানি-চাইনিজ-কোরিয়ানদের কি এজন্যই প্লাস্টিক পোড়ানো নিয়ে এত মাথাব্যাথা?
প্লাস্টিক বোতল আর ক্যান গুলো কে আলাদা করে সর্টিং করা, ডাম্প করা অনেক খরচান্ত ব্যাপার। সরকার কোম্পানি গুলোর সাহায্য চাইলেন। কালেকশন, সর্টিং আর ডাম্প করার জন্য খরচ ধরলেন পণ্যের ১০%। জুসের দাম ছিল ১০০ ইয়েন, ৯১ সাল থেকে দাম বাড়িয়ে হল ১১০ ইয়েন। কিন্তু কোম্পানি গুলো সরকার কে বাড়তি টাকাটুকু দিতে রাজি হলেন না। তাদের কমপ্লেইন হল সরকার এই টাকা যে অন্য কাজে ব্যবহার করবেনা তার গ্যারান্টি নেই। সেই দায়িত্ব কোম্পানি গুলোই নিলেন। কয়েক লাখ কর্মসংস্থান হলো। ৫০ লাখ ভেন্ডিং মেশিনের পাশে ৫০ লাখ ময়লার বাক্স বসিয়ে দিলেন। কত রকমের ডিজাইন কত রকমের বাক্স তৈরি হল। ধরুন প্রাণ এবং অন্যান্য জুস কোম্পানিগুলোকে কে বাংলার যত মুদির দোকান আছে সর্বত্র একটা করে ময়লার বাক্স বসিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে বলার সমান কথা। আমাদের মেয়ররা এই পলিসিটা মাথায় রাখতে পারেন।
৩) রিসেট পলিসি
প্যারালেলি কি হল জানেন? বাচ্চাকাল থেকে সবার মাথায় একটা পলিসি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। রিসেট পলিসি। উদাহরণ দিচ্ছি:-
(ক) ধরুন আপনি পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করলেন। রিসেট পলিসিটি হল ব্যবহারের পর এমনভাবে পরিস্কার করে যাবেন যেন পরবর্তী লোকটি আপনি যে অবস্থায় ব্যবহার শুরু করেছিলেন তার সমান বা আরো ভাল অবস্থায় ফেরত পান। মানুষের কাজটিকে সহজ করার জন্য তৈরি হল কত রকমের টেকনোলজি। আমার টয়লেট কাহিনি পড়ে দেখতে পারেন।
(খ) শুনে থাকবেন ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে বিশ্বকাপ খেলে জাপানি দল হেরে গিয়ে রেফারিকে দোষ দিলনা। বরং জাপানি দর্শকরা ঠিকই গ্যালারি পরিষ্কার করে বাড়ি ফিরলেন। গ্যালারি খানা যেমন ছিল, তার চেয়েও পরিষ্কার হয়ে গেল।
(গ) আমরা অনেক সময় মিটিং রুম অথবা বিভিন্ন পার্টির জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করি। মিটিং শেষ, পার্টি শেষ। তারপর সবাই মিলে পরিস্কার করে যেমন রুম ছিল তেমন করেই ফেরত দেই। সেটা আপনি প্রধান অতিথিই হোন আর সামান্য একজন দর্শক ই হোন।
(ঘ) জাপানিরা সবসময় মানিব্যাগ (ওয়ালেট) ব্যবহার করেন। টাকা এমন ভাবে রাখেন যে ১০০০ টা হাত পরিবর্তন হলেও ব্যাঙ্ক থেকে টাকা যেভাবে বেরিয়েছিল অনেকটা সেরকমই থাকে। বাংলাদেশে নতুন নোট জন্ম হবার পর প্রথম আঘাত টি পড়ে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে। নোটে দুইখান গর্ত করে সুতা দিয়ে বাঁধা অথবা স্টেপ্লার পিনটি প্রবেশ করেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। ছাত্রাবস্থায় আমার রান্নাবান্নার শখ ছিল। মাঝে মাঝে কিছু জাপানি বন্ধুদের দাওয়াত দিতাম। আমার প্লেট, পাতিল থেকে শুরু করে কিচেন পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যেত। কেউ কেউ এই রিসেট পলিসিটির অপব্যবহার করেছে। আমি ও তাদের একজন।
কতগুলো ট্রিভিয়া (জেনে লাভ নেই, না জানলে ও ক্ষতি নেই)
(১) জাপানের প্রধান মন্ত্রী নিজ হস্তে নিজের বাড়ির ময়লা পাড়ার নির্দিস্ট স্থানে ফেলেন। ঘরের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। ময়লা ব্যাগে ভরার দায়িত্ব ফার্স্ট ল্যাডি তার বউ এর। আর ফেলানোর দায়িত্ব প্রধান মন্ত্রী আবে-র।
(২) জাপানের ছাত্ররা পেন্সিল দিয়ে লেখে। পরীক্ষার খাতা হোক আর ক্লাস নোট হোক। পেন্সিলে লেখা মুছতে যে ইরেজার ব্যবহার করে তাতে যত মিলিগ্রাম ময়লা তৈরি হয়, সে গুলো ও একটা টিস্যু পেপার দিয়ে ধরে পকেটে করে নিয়ে নিকটস্থ ডাস্ট বিনে ফেলে।
(৩) শুধুই কি ড্রিঙ্কস কোম্পানি? চুইংগাম কোম্পানি গুলো চুইংগাম এর সাথে একরকম কাগজ জুড়ে দিলেন। ঐ কাগজে মুড়িয়ে এমনভাবে ফেলবে যাতে পরিবেশ ধ্বংস না হয়। কিছু কিছু ক্যান্ডি কোম্পানি এমন কাভার লাগিয়ে দিলেন যা খাওয়া যায়। মুখে দিলেই গলে যায়। সুপার মার্কেট, মুদির দোকান সব জায়গাতেই তিন ধরনের ময়লার বাক্স সেট করা হল- (ক) পোড়ানো যায় কাগজ জাতীয় ময়লা (খ) পোড়ানো যাবেনা ক্যান জাতীয় জিনিস (গ) প্লাস্টিক বোতল।
(৪) প্রত্যেক সিটি অফিস ময়লা ফালানোর জন্য একরকম প্লাস্টিক ব্যাগ নির্ধারিত করে দিলেন। বাসা বাড়ি, অফিস আদালতের ময়লা এই প্লাস্টিক ব্যাগে করে ফেলতে হবে না হয় ময়লার গাড়ি আপনার ময়লা নেবেন না।
(৫) এভারেস্ট নিয়ে জাপানিদের কয়েকটা রেকর্ড আছে। যেমন- মহিলা হিসাবে প্রথম এভারেস্ট জয় করেন একজন জাপানি মহিলা, নাম জুনকো তাবেই, ১৯৭৫ সালে। বয়স্কদের মধ্যে ও জাপান প্রথম স্থান। ৭৩ বছর বয়সে তামায়ে ওয়াতানাবে নামক এক দাদি এভারেস্টে ওঠেন । আচানক কাহিনি হলো – নগুচি নামক এক আরোহী দলবল নিয়ে এভারেস্টের ময়লা পরিষ্কার করতে উঠলেন। প্রথমবার ৮ টন ময়লা নিয়ে এভারেস্ট থেকে নামলেন।
অলিম্পিক দিয়ে শুরু হয়েছিল জাপানের শহর ক্লিন কর্মসূচি। ২০২০ সালের অলিম্পিককে পরিবেশ-বান্ধব করার জন্য সরকার নতুন নতুন আইডিয়ার আহবান জানিয়েছেন। একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি।
গোল্ড ম্যাডেল গুলো বানানোর প্রস্তাব দিয়েছেন একটা মোবাইল ফোন রিসাইকল কোম্পানি। মোবাইল ফোনে বিভিন্ন মেটালের মধ্যে একটু খানি স্বর্ণ ও থাকে। ৪৫০০ মোবাইল ফোন থেকে যতটুকু স্বর্ণ পাওয়া যাবে তার থেকে তৈরি হবে একটা ম্যাডেল।
এক স্বর্ণ খনি থেকে তোলা স্বর্ণ দিয়ে তৈরি হাজারটা গোল্ড ম্যাডেল
আর হাজারটা আবর্জনা থেকে তিল তিল করে সংগ্রহ করা স্বর্ণ থেকে বানানো একটা গোল্ড ম্যাডেল
-এই দুয়ের তুলনা যারা বোঝে, তাদের কাছে এই ম্যাডেল এর মূল্য অনেক। (সংগৃহীত)

One thought on “জাপান কেন এত পরিষ্কার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *