প্রতারণার জাদুকর সাহেদের বিষয়ে আসতে থাকা নিত্যনতুন তথ্যে হতবাক খোদ গোয়েন্দারা। শতভাগ মিথ্যা তথ্যকে সত্যের মতো করে সাহেদের উপস্থাপন নিয়েও বিস্মিত। সাহেদের প্রতারণার সব কৌশল নিয়ে এখনো ধন্দে পুলিশ কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, এমন বহুরূপী প্রতারক চাকরি জীবনে কম দেখেছি। সময় যাচ্ছে আর বহুরূপী এ প্রতারককে নিয়ে অবাক হওয়ার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতারণার পাশাপাশি মিথ্যা বলায়ও তার শৈল্পিকতার ছোঁয়া রয়েছে। তিনি নিজেকে করোনা রোগী বলে দাবি করেছেন। বিস্ময়কর তথ্য হলো, সাহেদ তার নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়ার সনদ নিয়েও জালিয়াতি করেছেন। করোনা আক্রান্ত অন্যের স্যাম্পল নিজের নামে চালিয়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সনদ নিয়েছেন। যদিও সত্যিই তিনি করোনায় আক্রান্ত হননি। সবার সহানুভূতি পাওয়া ও রিজেন্টের জালিয়াতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়া নিয়েও এমন গল্প ফাঁদেন প্রতারণার গুরু সাহেদ।
গোয়েন্দা পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, গতকাল দুপুরের পর সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা করলেও তিনি বারবার অসুস্থতার ভান ধরেন। সাহেদ বারবার বলছিলেন, আমার করোনা হলেও এখনো আমি দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষা করাইনি। এদিকে, সাহেদের প্রতারণা, নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকলে তাদের আইনি সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে র্যাব। সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানতে চালু করেছে একটি হটলাইন নম্বর। দেওয়া হয়েছে একটি ইমেইল অ্যাড্রেস। এ ছাড়া সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরিত চেক বইয়ের ৪৮টি পাতাসহ গিয়াস উদ্দীন জালালী (৬১) এবং তার গাড়ির চালক মাহমুদুল হাসান (৪০) নামে দুজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, শুরু থেকেই সাহেদ নিজেকে গুরুতর অসুস্থ বলে দাবি করেছিলেন। আদালতে গিয়েও নিজেকে করোনা আক্রান্ত হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। রিজেন্ট হাসপাতালে পাওয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বারবার তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ এড়ানোর কৌশল হিসেবে সাহেদ বারবারই তার প্রয়াত মা সাতক্ষীরা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাফিয়া করিমের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। বলছেন আওয়ামী রাজনীতিতে তার মায়ের ভূমিকার কথা। একইসঙ্গে সম্প্রতি করোনায় মৃত্যুবরণকারী বাবা সিরাজুল করিমের লাশ দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপের কথা শুনিয়ে তদন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পুলিশ জানায়, ভদ্রবেশে সমাজের সর্বত্র ছিল সাহেদের বিচরণ। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তিনি ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করে আসছেন। সারাক্ষণ স্যুটেড-বুটেড থাকা সাহেদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবলায়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা দফতরে ঘুরে বেড়াতেন তদবির বাণিজ্যে। নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, কোথাও ক্যাডেট পাস সেনা পরিবারের সদস্য, কোথাও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব), কোথাও সচিব, কোথাও গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। অনেকের কাছে তার পরিচিতি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব! আবার কখনো তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলে পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে প্রবেশের জন্য তার রয়েছে স্থায়ী পাস। নানা পরিচয় দেওয়া বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী সাহেদ প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রতারণার কাজে তার হাতেখড়ি। এরপর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সব সরকারের আমলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুসহ সব জায়গা।
সূত্র আরও বলছেন, সাহেদ তার প্রতারণার কিছু বিষয় কবুল করছেন। তবে এর নেপথ্য মদদদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে কিছু ব্যক্তির নাম বলেছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন তার অপরাধ থেকেও ওইসব ব্যক্তি ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছেন এবং লাভবানও হয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তদন্তের স্বার্থেই আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমরা সাহেদের বিষয়ে বেশকিছু নতুন তথ্য পেয়েছি। এখন এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরিত ৪৮টি চেকসহ গ্রেফতার ২ : সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরিত চেক বইয়ের ৪৮টি পাতাসহ রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ভায়রা গিয়াস উদ্দীন জালালী এবং তার গাড়ির চালক মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব-১-এর একটি দল বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে আশুলিয়ার নরসিংহপুরে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। গিয়াস উদ্দীন জালালী (৬১) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসাদী গ্রামের মৃত ফকির সুলতান জালালীর ছেলে। প্রাইভেট কার চালক মাহমুদুল হাসান শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ছোট কৃষ্টনগরের ফয়জুল মাতবরের ছেলে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, সাহেদের অনেক অপকর্মের সাক্ষী গিয়াস। নিজে মাদকসেবী এবং সাহেদকে মাদক সরবরাহ করতেন। সাহেদ পলাতক থাকা অবস্থায় তাকে গাড়ি সরবরাহ করেছেন গিয়াস। গিয়াসকে গ্রেফতারের সময় তার গাড়ি থেকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের সিল ও স্বাক্ষরিত প্রিমিয়ার ব্যাংক, গরিবে নেওয়াজ এভিনিউ শাখার ৪৮টি চেকবইয়ের পাতা, রিদম ট্রেডিংয়ের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রগতি সরণি শাখার একটি চেকবই, ১০ বোতল ফেনসিডিল ও ২ হাজার ১২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
সাহেদের তথ্য জানতে হটলাইন : গতকাল র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রতারক সাহেদের ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা যে কোনো তথ্য- অভিযোগ বা আইনি সহায়তা চাইলে র্যাব সদর দফতরের তদন্ত উইংয়ে যোগাযোগ করতে পারেন।
https://www.bd-pratidin.com/first-page/2020/07/18/549372